“অামরা ভূলবনা জাতির সূর্য্য সন্তানদের”

Slider সারাদেশ
1
অাল-আমিন অাহমেদ সালমান:-
আজ ঐতিহাসিক ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।বাঙ্গালী জাতির একটি অত্যন্ত শোকাবহ দিন।১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসর বিশ্বাসঘাতক স্বাধীনতাবিরোধী চক্র–জামাত,আল বদর, আল শামস, রাজাকারদের নজিরবিহীন নৃশংসতা এবং এক ভয়ংকর নীলনকশা বাস্তবায়নের একটি প্রামাণ্য দলিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বাহ্নেই শোষক পাকিস্তানী প্রশাসন বুঝতে পেরেছিল এদেশের সহজ-সরল মানুষগুলোকে আর শাসন-শোষন করা যাবেনা। বাঙ্গালী জেগে উঠেছে।
এদেশে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের পতন অনিবার্য। এটা কেবল কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই পরাজয়কে সহজে মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা।সুজলা -সুফলা, শস্য-শ্যামল এই দেশটিকে শোষন করেই যে পাকিস্তান সয়ং সম্পূর্ণ।
বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় এই জাগরণে এদেশের সূর্য -সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল আলোকবর্তিকার।ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙ্গালীদের ধাবায়ে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের যে কোন হীন-চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাঁরা বারবার সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এদেশের সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছেন। যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
পাকিস্তানীরা যেহেতু বুঝতে পেরেছিল এদেশে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে তারা এদেশের মানুষকে একটা মরণ কাঁমড় দেবার জন্য মরীয়া হয়ে উঠে।তাদের এই কুৎসিত ইচ্ছায় আরো ইন্ধন যোগায় এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দালালচক্র। এই স্বাধীনতাবিরোধী, দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা দালালগুলো বুঝতে পেরেছিল এতদিন পাকিস্তানী প্রভুদের পা চাটার ,তাদের সাথে হাত মিলিয়ে হত্যা-ধর্ষণ-লুঠতরাজের যে জঘন্য ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে তার ফলশ্রুতিতে এদেশের মাটিতে বসবাস করা তাদের জন্যও অসম্ভব হয়ে উঠবে।কাজেই ঘাতক-দালাল চক্রের একটাই উদ্দেশ্য যেভাবে যতটুকু সম্ভব এদেশের ক্ষতি করা। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির যে কোন বিপর্যয়ে অগ্রনী ভূমিকা নিয়ে সমস্যা সমাধানের পন্থা নির্ধারণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন ধীমান ব্যক্তিবর্গ তাদের এই ধবংস-প্রক্রিয়ার প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হন।এদেশকে মেধাশূন্য করে পঙ্গু করে ফেলার এক ভয়াবহ নীলনকশার পরিকল্পনা করে তারা । যার ফল হবে এদেশের মানুষের জন্য মারাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী। কোন জাতির অগ্রসরমানতা বা সার্বিক বিকাশের ধারাকে প্রতিহত করতে এর থেকে মোক্ষম অস্ত্র আর কি হতে পারে?
২৫ শে মার্চের কালোরাত্রি থেকেই ঘাতক-দালালদের বুদ্ধিজীবী নিধন-যজ্ঞ শুরু হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা,ফজলুর রহমান খান,গোবিন্দ চন্দ্র দেব সহ আরো অনেকেই এই কালোরাত্রিতেই শহীদ হন।শুধু ঢাকা কেন সমস্ত বাংলাদেশ(ত্তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)জুড়েই চলছিল এই হত্যা প্রক্রিয়া।সিলেটে চিকিৎসারত অবস্থায় হত্যা করা হয় ডাক্তার শামসুদ্দিন আহমদকে।
শিক্ষাবিদ,চিকিৎসক,প্রকৌশলী,সাহিত্যিক,সাংবাদিক,ব্যবসায়ী,রাজনীতিক,ছাত্র কেউই এই ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাননি।প্রতিদিনই কারো না কারো বাসায় ঢুকে বিশেষ কোন ব্যক্তিকে ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো অজ্ঞাত কোন স্থানে।যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো নারকীয় নির্যাতনের পরে তাদের সবাইকেই মেরে ফেলা হতো।ওরা কেউ আর ঘরে ফিরে আসেনি।দু,একটা ব্যতিক্রম হয়তবা ছিল।কিন্তু সেইসব ভাগ্যবানের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো ছিলনা।
২৫ শে মার্চের মাঝরাত থেকেই দেশ জুড়ে হত্যা -ধর্ষণ-লুঠতরাজের পাশাপাশি বাছাই করে করে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের নিধন-পর্বও চলছিল প্রায় প্রতিদিনই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো নয় মাসই সুপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বুদ্ধিজীবী হত্যা চলতে থাকে। পাকিস্তানীঘাতকদের আত্মসমর্পনের ঠিক দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বরের বীভৎস- নারকীয়- পাশবিক হত্যাকান্ডের কোন তুলনাই হয়না।একসাথে এত বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা এর আগে আর ঘটেনি।
১৪ই ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্য বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। ঘাতক-দালাল চক্র এই পৈশাচিক-নির্মম নিধন যজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়ের বাজার সহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ই ডিসেম্বর পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরে আত্মীয়-স্বজনেরা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁদের লাশ খুঁজে পায়। ঘাতকবাহিনী আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা,”আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিপিটি ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। গামছা দুটো আজও অখানে পড়ে আছে। পরনে কালো ঢাকাই শাড়ী ছিল। এক পায়ে মোজা ছিল। মুখ ও নাকের কোন আকৃতি নেই।কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে।যেন চেনা যায় না।মেয়েটি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যবতী।স্তনের একটা অংশ কাটা। লাশটা চিৎহয়ে পড়ে আছে।বিভৎস চেহারার দৃশ্য বেশীক্ষণ দেখা যায়না। তাকে আমি চিনতে পারিনি। পরে অবশ্য সনাক্ত হয়েছে যে ,মেয়েটি সেলিনা পারভীন। ’শিলালিপি’র এডিটর।তার আত্মীয়রা বিকেলে খবর পেয়ে লাশটি তুলে নিয়ে গেছে।”
আরেকটি বর্ণনা,”পাশে দুটো লাশ, তার একটির হৃৎপিন্ড কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিন্ড ছেঁড়া মানুষটিই হল ডঃ রাব্বী। -ডঃ রাব্বীর লাশটা তখনও তাজা। জল্লাদ বাহিনী বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে।তারা জানতো যে তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তার হৃৎপিন্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছে।
এমনি আরো অজস্র লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়।সেইসব মর্মান্তিক ঘটনার শুনে বারবার শিউরে উঠতে হয়।এই ঘাতকদালালচক্রের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করার মতো উপযুক্ত ভাষা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়না। এই ঘাতকদালালচক্র দেশের সাথে ,স্বজনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম জায়গায়। মীরজাফর,মীরনের পাশাপাশি এদেশের মানুষ আজীবন ঘৃণা ভরে” রাজাকার ‘শব্দটিও উচ্চারণ করে যাবে।
যুদ্ধকালীন সমস্ত সময় জুড়েই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলেও ১৪ই ডিসেম্বরের মতো একসাথে এত বুদ্ধিজীবীকে এর আগে হত্যা করা হয়নি ,এজন্যই এই দিনটিকেই “শহীদ বুদ্ধীজীবী দিবস” রূপে পালন করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ১৪ই ডিসেম্বরকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” বলে ঘোষণা দেন। প্রতি বৎসর এই দিনটিতে আমরা আমাদের অকাল-প্রয়াত শ্রেষ্ট সন্তানদের আবেগ-আপ্লুত হয়ে স্মরণ করলেও স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও সেইসব ঘাতকদালালদের বিচার করতে পারিনি যারা ছিল এই হত্যাকান্ডগুলোর প্রত্যক্ষ হোতা। এর অন্যতম কারন হয়ত এজন্যই যে এই ঘাতকদালাল চক্র এবং এদের দ্বারা মগজধোলাইকৃত উত্তরসূরিরা এদেশের আনাচে-কানাচে প্রবলভাবে সক্রিয়।
জাতিকে মেধাশূন্য করার যে প্রক্রিয়া একাত্তরের ঘাতকচক্র শুরু করেছিল তাদের উত্তরসূরিরাও একই উদ্দেশ্যে এই দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে নানা ভুল তথ্য ,ভুল ইতিহাস পরিবেশন করে যাচ্ছে যাতে করে এদেশের মানুষ একটা বিভ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়। এই ঘাতকদালালদের সম্পূর্ণরূপে নির্মুল করা না হলে জাতির সামনে আরো ভয়াবহ সময় আসবে এতে কোন ভুল নেই। এবং আমরা যারা অাজ-আগামী প্রজন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমাদের বুকে লালন করতে হবে। তাহলে আমাদের স্বাধীনতার সম্মানের সার্থকতা থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *