বাহুবলী বঙ্গতনয়া!

Slider সারাবিশ্ব

123616YeMRgnZ

 

 

 

 

মিষ্টি মুখ। লম্বা চুল।

কাজলে ঢাকা গভীর টানা-টানা চোখ। হালকা মেদযুক্ত শরীরে জড়ানো শাড়ি। কাট টু, প্রায় ১৪ ছুঁইছুঁই বাইসেপস। ছোট করে কাটা চুল। ৩৭ ইঞ্জির চওড়া ছাতি। ওজন ৫৫ কেজি। অবলীলায় ১৩০ কেজি ওজন তুলে ফেলার ক্ষমতা।

বঙ্গতনয়া বলতে যে কোমল ছবিটা ভেসে ওঠে, দ্বিতীয় মেয়েটি তার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। তাই না! বাঙালি মেয়ে সম্পর্কে আপনার-আমার চিরাচরিত ধারনাকে মুহূর্তে ভেঙে চুরমার করে দিতে তৈরি দ্বিতীয় নারীটি।

অষ্টাদশী আপাদমস্তক বাঙালি মেয়ে। নাম ইউরোপা ভৌমিক। বডি-বিল্ডিং মেয়েদের জন্য নয়- গোছের মন্তব্য করেন যাঁরা, তাঁদের যাবতীয় প্রশ্নের জবাব হিসেবে রইল দেশের সর্বকনিষ্ঠ মহিলা বডি-বিল্ডার ইউরোপার কাহিনি।

ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং নিদেনপক্ষে সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো ছেড়ে কি না সটান বডি-বিল্ডিং? এমন পেশাকে বেছে নেওয়ার কারণ কী, জানতেই টেলিফোনে যোগাযোগ ইউরোপার সঙ্গে। কথা বলার জন্য সোজা বাড়িতেই ডেকে নিলেন অষ্টাদশী। ভরদুপুরে ভিআইপি রোড-সংলগ্ন বাড়িতে উষ্ণ অভ্যর্থনাও জানালেন তাঁর মা। মাথায় তখন হাজারো প্রশ্ন মেয়েটাকে নিয়ে। আর সে সবের উত্তর দিতে পারেন যিনি, সেই ইউরোপা খাটের ওপর দু’পা তুলে বসে ব্যস্ত মাসল রিল্যাক্সেশনে। পাশে শুয়ে ইয়া বড় টেডিবেয়ার, বোরা। বাবা, বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাপ্টেন। সান্টা ইউরোপা নামের এক জাহাজে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেবার সময় মা সুপর্ণা টের পান তিনি সন্তানসম্ভবা। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে জন্মের পর, বাঙালি ভৌমিক পরিবারের বড় মেয়ের নাম তাই দেওয়া হয় ইউরোপা। স্রোতের বিপরীতে ভাসার শুরুটা হয়তো সেখান থেকেই।

‘দেখতে খারাপ, মোটা, বেঁটে ছিলাম ছোটবেলায়। আর তাই স্কুলে বন্ধুদের টিটকিরি শুনতে হত খুব,’ নিজের বিষয়ে বলতে গিয়ে প্রথমেই জানালেন ইউরোপা গলায়। কিছুটা থেমে বললেন, ‘বেঁটে এখনও আছি যদিও। কিন্তু, এখন আমার আর কিছু যায় আসে না। কারণ, এখন রাস্তায় বেরোলে লোকে আমার দিকে যে ভাবে তাকায়, সে দৃষ্টিতে বিস্ময় আর সম্ভ্রম মেশানো থাকে। যেটা আমি খুব উপভোগ করি। ‘ দুর্বল হয়ে বেঁচে থাকাটা অনেকেরই পছন্দ নয়। কিন্তু, সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে বডি-বিল্ডিংয়ের মতো কঠিন পথ বেছে নেওয়া কেন? ‘আসলে আমি রোগা হওয়ার জন্য জিমে যোগ দিয়েছিলাম। খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দিয়ে দুই মাসের মধ্যে ১০ কেজি ওজন কমিয়েও ফেলেছিলাম।  বলতে পারেন অ্যানুরেক্সিয়া হয়ে গিয়েছিল আমার। আমার তৎকালীন জিম ইনস্ট্রাক্টর আমাকে ওজন তোলার পরামর্শ দেন তখন। আমার ওজন কম রেখে বডিমাস বাড়ানোর দিকেও নজর দিতে শুরু করি তখনই,’ বললেন ইউরোপা।

আর পাঁচজন মেয়ে যেখানে ওজন তোলার নামেই ভয় পেয়ে যায়, পাছে পেশি জন্মায় শরীরে, এই দুশ্চিন্তায়। সেখানে, ধীরে ধীরে বেঞ্চপ্রেস, ওয়েট লিফটিংয়ের প্রেমে পড়ে যান, ‘আমি সব সময় মানুষের চোখে একটা সম্ভ্রম দেখতে চেয়েছিলাম আমার জন্য। চেয়েছিলাম, আমার দিকে ধেয়ে আসা সব বুলিংয়ের জবাব দিতে। বডি-বিল্ডিং শুরু করার পর, টের পাই সেটা হচ্ছে। তাতে আমার উৎসাহ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ‘ সাফ জবাব ইউরোপার।

তখনও সাবালক হননি। সতীশ সুগার ক্ল্যাসিকস প্রতিযোগিতায় যোগ দেন নিছকই আগ্রহে। সর্বকনিষ্ঠ মহিলা বডি-বিল্ডার হিসেবে। সে বছর প্রতিযোগিতায় কিছু না হতে পারলেও, বডি-বিল্ডিংকেই নিজের সর্বস্ব দেওয়ার পণ করে বাড়ি ফেরেন ১৬ বছরের ইউরোপা। তারপর টানা এক বছর কোচ ইন্দ্রনীল মাইতির কাছে ট্রেনিং নিয়ে ফের সেই প্রতিযোগিতার মঞ্চে ফেরেন। দ্বিতীয় হয় সেখানে। তারপর একে একে ন্যাশনালস, আর ২০১৭র আগস্টে সোজা সিওল। মিস এশিয়া ২০১৭র প্রতিযোগিতার মঞ্চে।

লড়াইটা শুনতে সহজ হলেও, আদতে সহজ ছিল না মোটেও। একে তো নারীর শরীরের গড়ন আদ্যোপান্ত ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে গড়ে তোলা। সেই প্রক্রিয়ায় পরিবার, বন্ধুদের পাশে পাওয়া তো দূর অস্ত। উল্টে তাঁদের গঞ্জনাই শুনতে হয়েছে ইউরোপাকে। কোনো ধাতব পদার্থে তৈরি হয়তো মেয়েটার মনোবল। তাই লোকে ভাঙার যত চেষ্টা করেছে, ততই মজবুত হয়েছে সেটা। ইউরোপার কথায়, ‘বাবা-মা প্রথম থেকেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়ে আমার মাথায় চাপা বডি-বিল্ডিংয়ের ভূত ছাড়ানোর চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু, আমি যে কাজটা করছি, সেটার প্রতি ভালোবাসা আর মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা দেখে এখন ওরাও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘ আর বন্ধুরা? ‘আমার কোনো বন্ধু নেই। যাঁদের বন্ধু ভেবেছিলাম, তারা আমাকে ছোট করা ছাড়া আর কিছুই করেনি,’ ইউরোপার গলাটা তখন বরফের ঠাণ্ডাকেও হার মানায়। আর বিশেষ বন্ধু? আছে? নাকি, পুরুষ শরীরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া দৈহিক গড়ন দেখে তারা কাছেই আসতে চায় না? প্রশ্নটা করতেই মুহূর্তেই লাজুক ইউরোপা। আর পাঁচজন অষ্টাদশীর মতোই ইউরোপা বলে ওঠে, ‘আপাতত একজনকে ডেট করছি। ও এ দেশের নয়। এবং আমার বডি-বিল্ডিংয়ের মারাত্মক ফ্যান। খুব অনুপ্রাণিত করে আমাকে। ‘ এ রাজ্যের সম্ভবত একমাত্র মহিলা বডি-বিল্ডার (যিনি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন ) হয়ে এ রাজ্যের বডি-বিল্ডিংয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী মত তাঁর? ‘বডি-বিল্ডিং অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ এক পেশা। শুধু ট্রেনিংই নয়। নিজের শরীর গড়ে তুলতে যে খাবার খেতে হয়, তার খরচও অনেক। আমার বাড়িতেই দেখুন না, আমার একার খাবারের খরচ, গোটা পরিবারের খাবারের খরচের প্রায় পাঁচগুণ। আর স্পনসর মেলাও খুব মুশকিল,’ মত তাঁর। বাঙালি মেয়েরা কী অনুপ্রাণিত হয় ইউরোপাকে দেখে? ‘আজকাল অনেকে এসে বলে বডি-বিল্ডিং করতে চায় বলে জানায় আমাকে। আমার ভালো লাগে এটা ভেবে যে, আমাকে দেখেও কেউ অনুপ্রাণিত হচ্ছে। কোনো মেয়ে বডি-বিল্ডিংয়ের জন্য সাহায্য চাইলে আমি তাঁকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। ‘ জানিয়ে রাখলেন ইউরোপা।

নতুন বছরে ইউরোপার লক্ষ্য হলো, আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অফ বডি-বিল্ডিং অ্যান্ড ফিটনেস (আইএফবিবি )-এর প্রো-কার্ড অর্জন করা। আর তারপর অলিম্পিয়ান হিসেবে দেশকে মেডেল এনে দেওয়ার লক্ষ্যে এগোবেন ইউরোপা। সূত্র : এই সময়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *