রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা শুনলেন পোপ

Slider বিচিত্র

0152531_kalerkantho-2017-2--12-

 

 

 

 

মিয়ানমার সফরকালে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করাও বারণ ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের জন্য। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ সফরে এসে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কাছে তাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের বিবরণ শুনে পোপ এতটাই বিচলিত হয়েছেন যে নিপীড়কদের পক্ষে তিনিই ক্ষমা চেয়েছেন।

‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেই তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যেও আজ সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি। ’

মা-বাবাসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হারিয়ে নিঃস্ব মিয়ানমারের মংডুর তুলাতলী গ্রামের এতিম রোহিঙ্গা কিশোরী শওকত আরা (১৪) পোপকে শুনিয়েছে কিভাবে মিয়ানমার বাহিনী ভয়াল নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে অনাথ করে দিয়েছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে যে তার ওপর এমন বর্বর নির্যাতন নেমে আসবে তা তারা আঁচও করতে পারেনি। মিয়ানমার বাহিনী তাদের পুরো গ্রাম ঘিরে গ্রামবাসীদের হত্যা করে। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গোলার আগুনে তাদের পুরো গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তার মা, বোনকে জবাই করা হয়।

শওকত আরার মতো রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ১৮ জন প্রতিনিধিকে সাক্ষাৎ দিয়ে এক এক করে তাদের দুর্ভোগের কথা শুনেছেন পোপ ফ্রান্সিস। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আর্চবিশপ হাউসের বাগানে আন্তর্ধর্মীয় ও আন্তর্মাণ্ডলিক সমাবেশে বক্তব্য ও প্রার্থনা শেষে মঞ্চে রোহিঙ্গাদের ডেকে নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলেন ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু। পোপ মাথা নুইয়ে তাদের হাতে হাত রেখে দুর্দশার কথা শোনেন।

ওই সময় তাঁকে বিষণ্ন ও বিচলিত দেখাচ্ছিল। পোপ রোহিঙ্গাদের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেন এবং পরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাদাভাবে প্রার্থনা করেন।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির থেকে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে পোপ বলেন, ‘আপনাদের কষ্ট দেখে আমাদের প্রশান্তি বিঘ্নিত হয়। আমরা সবাই শান্তি চাই। যেখানে মন্দ রয়েছে, সেখানেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কাজ করছি। ’

গত ২৭ নভেম্বর থেকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফরে প্রথমবারের মতো ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ উচ্চারণ করে পোপ বলেন, ‘আজ সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি রোহিঙ্গাদের মধ্যেও। যারা আপনাদের নিপীড়ন করেছে, আঘাত করেছে, তাদের নামে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি আপনাদের মহান আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ’

আন্তর্ধর্মীয় ও আন্তর্মাণ্ডলিক সমাবেশে পোপ, ক্যাথলিক খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের অনুসারীরা একসঙ্গে মিলে প্রার্থনার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্ভোগের অবসান কামনা করেন। সেখানেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ উচ্চারণ করে তাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়। পল বিশপ সরকারের পরিচালনায় ওই প্রার্থনায় বলা হয়, ‘আমরা বিশেষভাবে আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারের অসহায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করি। অসহায় মানুষ জীবন রক্ষার জন্য নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করছে এবং মানবেতর জীবন যাপন করছে। ’

প্রার্থনায় আরো বলা হয়, ‘হে পৃথিবীর মালিক, আমাদের পৃথিবীতে তুমি শান্তি ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা কর। বিভিন্ন দেশের শাসনকর্তা, যাদের তুমি ক্ষমতা দিয়েছ, তাদের তুমি তোমার বিজ্ঞতা ও দয়া দ্বারা পরিচালনা কর; যেন প্রেম ও যত্নে তারা তাদের জনগণের সেবায় ক্ষমতা ব্যবহার করে। ’

জানা গেছে, পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ১৮ রোহিঙ্গার প্রত্যাশা ছিল প্রায় অভিন্ন। তারা তাদের দুর্ভোগ লাঘব এবং নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে পোপের ভূমিকা প্রত্যাশা করেছে। হাতে গুলির ক্ষত নিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা ২৪ বছর বয়সী কৃষক জাফর আলম পোপকে বলেন, ‘আমরা যখনই বলি, আমরা রোহিঙ্গা, তখনই আমরা হামলার শিকার হই। আমাদের জীবনের সঙ্গে এই নাম জড়িত। আমি রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে এবং রোহিঙ্গা পরিচয়ের কারণে হামলার শিকার না হলেই কেবল আমি ফিরে যাব। ’ ১৪ বছর বয়সী ভাগ্নিকে নিয়ে পোপের সঙ্গে দেখা করেন জাফর আলম। পোপকে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের প্রত্যেক নারী ও পুরুষের জমির অধিকারসহ পূর্ণ মানবাধিকার থাকা উচিত। আমাদের ফিরে যাওয়ার আগে এগুলো নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। ’

২৭ বছর বয়সী হাজেরা খাতুন, তাঁর স্বামী ৩৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ নুরউল্লা পোপের সঙ্গে দেখা করেন তাঁদের পাঁচ বছর বয়সী কন্যাশিশুকে নিয়ে। শিশুকন্যাটি মিয়ানমারে এত নির্যাতন-নিপীড়ন দেখেছে যে ভয়ে এখন সে আর ঘুমাতেই পারে না। ১০ বছর আগে বিয়ে হলেও হাজেরা-নুরউল্লা দম্পতি এক সপ্তাহও স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবন কাটাতে পারেননি রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত নিপীড়নের কারণে। গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া হাজেরা রোহিঙ্গা নারীদের যৌন নিপীড়নের তথ্য তুলে ধরেছেন পোপের কাছে। তিনি বলেন, ‘নারী হিসেবে আমরা সব সময় রাখাইন রাজ্যে হামলার লক্ষ্য। আমরা একা বাইরে যেতে পারি না। ’

মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ধর্মীয় শিক্ষক মোহাম্মদ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য পোপকে তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর কাজে লাগানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।

রাখাইন রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ৫২ বছর বয়সী খায়রুল আমিন প্রাণ বাঁচাতে সব ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন গত ৫ সেপ্টেম্বর। গত সন্ধ্যায় তিনি পোপকে বলেন, রাখাইন রাজ্যে পুরোমাত্রায় বৈষম্য চলছে। রোহিঙ্গারা নিয়মিত চাঁদাবাজির শিকার হয়েছে।

বাবার মতো গ্রাম্য চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে মোহাম্মদ ইদরিসের। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এই সদস্য পোপের কাছে মিয়ানমারে তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার এবং চলাচলের স্বাধীনতা পাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

কক্সবাজারের বালুখালী ১ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা লালু মাঝি বলেন, ‘পোপের সঙ্গে আমরা কথা বলতে পেরেই শান্তি পাচ্ছি। পোপ আমাদের কথা মন দিয়ে শুনেছেন। পোপ আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন। তিনি বিশ্বাবাসীকে নিয়ে আমাদের জন্য কাজ করার কথা দিয়েছেন। এতেই আমরা অত্যন্ত খুশি। ’

রিকশায় চড়ে সমাবেশে : এর আগে সন্ধ্যায় ঢাকায় আর্চবিশপ হাউসের বাগানে আন্তর্ধর্মীয় ও আন্তর্মাণ্ডলিক সমাবেশে পোপ হাজির হন রিকশায় চড়ে। ‘সুস্বাগতম, সুস্বাগতম, পুণ্য পিতা, তোমায় জানাই বাংলায় স্বাগতম’ গানের মাধ্যমে পোপকে স্বাগত জানানো হয়।

সমাবেশে উপস্থিত ক্যাথলিক, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজসহ সব ধর্মের প্রতিনিধিদের পক্ষে পোপকে শুভেচ্ছা জানান কার্ডিনাল ডি রোজারিও। সমাবেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তিনি বলেন, এই আন্তর্ধর্মীয় সমাবেশ ধর্মের নামে সব ধরনের উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস রুখতে বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে স্বামী ধ্রুবেশানান্দ বলেন, ‘সব ধর্মবিশ্বাস ও পথের লক্ষ্য এক। কিন্তু আমাদের নিজ মত ও আদর্শে নিষ্ঠা রাখতে হবে। ’

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যে ছয়টি দাবি পেশ করেছেন তার ওপর ভিত্তি করে রোহিঙ্গাদের মানুষের মর্যাদা দিয়ে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ইমেরিটাস প্রফেসর আনিসুজ্জামান রোহিঙ্গা সংকটের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যারা সংঘাতে আশাহত তারা নিশ্চয়ই পোপের শান্তি ও সম্প্রীতির বাণীতে সান্ত্বনা খুঁজে পাবে।

খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে থিওফিল নিশারক নকরেক বলেন, ৪৫টি জাতি-গোষ্ঠীর বাংলাদেশে পারস্পরিক সুসম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্ধর্মীয় ও আন্তর্মাণ্ডলিকভাবে আরো গভীর সম্পর্ক গড়তে তিনি পোপের আশীর্বাদ প্রত্যাশা করেন।

পোপ ফ্রান্সিস তাঁর বক্তৃতায় এ দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর সম্প্রীতিরও প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, অনুষ্ঠানে যে সংগীত ও নৃত্য পরিবেশিত হয়েছে তাতে বিশ্বের ধর্মগুলোর শিক্ষা, শান্তি, সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ববোধের বার্তার প্রতিফলন ঘটেছে। সব ধর্মের লোকজনের পারস্পরিক সম্মান ও শুভেচ্ছার প্রতিফলন এই সমাবেশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার দেশ প্রতিষ্ঠাকালীন মূল নীতিতেই রয়েছে। ধর্মের নামে যারা সমাজে বিভাজন, ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়াতে চায় তাদের জন্য এটি এখনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে।

পোপ বলেন, বিশ্বাসী ও শুভ কামনাসম্পন্ন সব মানুষের পারস্পরিক সংলাপ, সহযোগিতা ও আলোচনার আগ্রহ বিশেষ ইতিবাচক লক্ষণ। এটি নিছক সহনশীলতার চেয়েও বড়। তিনি বলেন, ‘বৈচিত্র্য কোনো ঝুঁকি নয়, বরং তা সমৃদ্ধির উৎস। এটি আমাদের খোলা মনে উপলব্ধি করতে সহযোগিতা করে যে অন্যের মতামত নতুন কোনো পথ এবং সেটি কোনো বাধা নয়। ’

পোপ আরো বলেন, ‘ধর্ম আমাদের প্রতিবেশীদের মঙ্গলের ব্যাপারে শিক্ষা দেয়। এটি একটি উন্মুক্ত হৃদয়ে প্রবহমান নদীর মতো। এটি ঘৃণা, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও সহিংসতা দূর করে। ’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এই বিশ্ব, অভিন্ন বসতির প্রতি অঙ্গীকার এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাড়া দেওয়ার মাধ্যমে সেই পথ বেছে নিয়েছে।

পোপ এ দেশে দুঃখ, প্রার্থনা ও সংহতির উদাহরণ দিতে গিয়ে রানা প্লাজা ধ্বসের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা ও সহযোগিতার চেতনা কেবল শান্তি ও সম্প্রীতির সংস্কৃতি সৃষ্টিতেই ভূমিকা রাখে না, এটি হৃদয়কেও আলোড়িত করে।

এক লাখ খ্রিস্টানকে নিয়ে প্রার্থনা : পোপ ফ্রান্সিস গতকাল সকালে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় এক লাখ ক্যাথলিক খ্রিস্টানকে সঙ্গে নিয়ে উন্মুক্ত প্রার্থনা করেছেন। এ দেশে খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের এ যাবৎ বৃহত্তম এ খ্রিস্টযাগ (মাস) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সারা দেশ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও এতে যোগ দেন। ওই প্রার্থনা অনুষ্ঠানে ১৬ জন যাজকের অভিষেক হয়েছে। প্রায় আড়াই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে প্রার্থনা করেন। এরপর তিনি একটি খোলা গাড়িতে চড়ে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান।

এ ছাড়া গতকাল ক্যাথেড্রাল পরিদর্শন এবং বিশপদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। ঢাকায় আনুষ্ঠানিকতা শেষে আজ শনিবার বিকেল ৫টার দিকে রোমের উদ্দেশে পোপের ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *