মাছ উৎপাদনে পেছাল বাংলাদেশ

Slider বিচিত্র

0326dcb884e7851c69073404ce474a7c-5a19513b3e021

 

 

 

 

চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে এক ধাপ নিচে নেমে গেছে। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। এ বছর তা পঞ্চম স্থানে নেমে এসেছে। বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে ভিয়েতনাম। গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের মাছ উৎপাদনের পরিসংখ্যান নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার স্ট্যাটিসটিকস-২০১৭ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন সর্বশেষ ২০১৫ সালের তথ্যকে ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশে ওই বছর মোট ২১ লাখ মেট্রিক টন চাষের মাছ উৎপাদিত হয়েছে। মূলত প্রতি দুই বছর পর এফএও রোম কার্যালয় থেকে মাছের উৎপাদনবিষয়ক বৈশ্বিক এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে থাকে।
এবার এক ধাপ পেছালেও ১৫ বছর ধরে শীর্ষ পাঁচেই অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনটি বলছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের চাষের মাছের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এ উৎপাদন প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ২১ লাখ মেট্রিক টন। আগের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ যখন চতুর্থ অবস্থানে ছিল, তখন (২০১২ সালের পরিসংখ্যান) চাষের মাছের উৎপাদন ছিল ১৭ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন বাড়লেও অবস্থানে এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নদী-খাল-বিল ও হাওরের মতো উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন খুব বেশি বাড়েনি। ওই খাতে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ১৫তম। ২০০৬ সালে এই ক্ষেত্র থেকে মাছ আহরণ করা হতো ১৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৫ সালে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। আর আহরণ ও চাষের মাছ মিলিয়ে মোট উৎপাদন প্রায় ৩৭ লাখ মেট্রিক টন।
এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘আমাদের দেশীয় মাছের বিচরণ ভূমি অর্থাৎ প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো রক্ষা করতে হবে। এ জন্য সরকার নদী খনন ও শিল্পকারখানা দূষণ রোধে কাজ করছে। তবে একই সঙ্গে দেশীয় মাছ যাতে পুকুরে চাষ করা যায়, তার উন্নত জাত ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবনের দিকে আমরা মনোযোগ দিয়েছি।’
তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩৮ লাখ ৩২৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে চাষের মাছের পরিমাণ ২২ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টন। এফএওর তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ চাষের মাছ উৎপাদনকারী দেশ যথাক্রমে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ। আগের তালিকায় ভিয়েতনাম ছিল পঞ্চম অবস্থানে।
দেশে চাষের মাছের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার ফলে অন্য ধরনের সমস্যাও তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন দেশের মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের হিসাবে, দেশে মূলত ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিকভাবে পুকুর ও ঘেরে চাষ হয়। দেশে মিষ্টি পানির মাছের প্রজাতি আছে ২৬০টি। ক্রমাগত নদীদূষণ, কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং তা পানির সঙ্গে ধুয়ে নদী-জলাশয়ে পড়ার ফলে সেখান মাছ মারা যাচ্ছে। তাঁদের মতে, এর ফলে দেশের প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। এতে দেশীয় মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে ওই সব মাছের পুষ্টি ও স্বাদ থেকে দেশের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশ বায়োলজি ও জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা এ আর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে যেসব পুকুরের মাছ চাষ হয়, তার ৫০ শতাংশই বিদেশি প্রজাতির মাছ। ষাটের দশকে আসা তেলাপিয়া দিয়ে তা শুরু হয়। পরে থাই পাঙাশ, ভিয়েতনামের কই, থাই কই, আফ্রিকান মাগুরের মতো আগ্রাসী প্রজাতির মাছ দেশে চাষ হচ্ছে। দেশি মাছের তুলনায় এগুলির পুষ্টিমান ও স্বাদ কম। ফলে আমাদের মাছের উৎপাদন বাড়ছে, বিশ্বের চতুর্থ বা পঞ্চম—এসব তথ্য শুনে আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে হবে না। আমাদের দেশীয় জাতগুলিকে আধুনিক পদ্ধতিতে কীভাবে চাষের আওতায় আনা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। জলাশয়ের প্রাকৃতিক উৎসগুলিতে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।’
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত মাছের প্রায় ২০ শতাংশ আসে রুই-কাতলা থেকে। এ ছাড়া ১৩ শতাংশ পাঙাশ, ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ ইলিশ, প্রায় ১০ শতাংশ তেলাপিয়া থেকে আসে। দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের ৬০ শতাংশ আসে মাছ থেকে। গত এক যুগে দেশের বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যের দাম দুই থেকে তিন গুণ বাড়লেও চাষের মাছের দাম প্রায় অপরিবর্তিত আছে। পাঙাশ, তেলাপিয়া ও রুই মাছের দাম উল্টো কমেছে।
এ ব্যাপারে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে পুকুরে প্রতি হেক্টর জমিতে ৪ হাজার ৬০০ কেজি মাছ হয়। অথচ বন্যাপ্রবাহ এলাকায় একই পরিমাণ জমিতে ২৭৬ কেজি, হাওরে ৪০৮ কেজি, কাপ্তাই লেকে ১৩৯ কেজি হয়। সেখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করেও আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে উৎপাদন আরও বাড়াতে পারি। এতে দেশি মাছের স্বাদ পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনও আরও ১০ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন বাড়ানো যাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *