সহকর্মী উৎপল নিখোঁজ ! আমরা সংবাদকর্মীরাও প্রস্তুত আছি !

Slider খুলনা

Photo

 

 

 

 

 

এম আরমান খান জয় :
এক শ্বাসরুদ্ধকর গুমোট হাওয়া বইছে। ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মায়ের বুকে শান্তি নেই, উদ্বিগ্ন পিতা ঘুমাতে পারছেন না। স্বামী না ফেরা পর্যন্ত স্ত্রী-সন্তাদের সব শান্তি ও স্বস্তি হারাম হয়ে গেছে। গুম বা নিখোঁজ কেউ ফিরে আসছে। কোথায় ছিলেন কেমন ছিলেন, নিজেরাও বলছেন না, গণমাধ্যমও না। গণমাধ্যম যেন খোঁজও নিতে নারাজ। কোথায় যেন অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা সব, কখনো-সখনো ঘাড়ের ওপর। অচেনা-অজানা গরম নিঃশ্বাস বইতে শুরু করেছে। অস্থির, অশান্ত এক ক্রান্তিকাল যেন অতিক্রম করছি আমরা। কখনো গুজবে ভাসে দেশ, কখনো ওঠে একের পর এক বিতর্কের ঝড়। হদিস পাই না, কূলকিনারা পাই না- অন্ধের মতো। মোমবাতি জ্বালানোর দিয়াশলাই খোঁজার মতো হাতড়াতে থাকি, হাতের মুঠোয় কিছুই ধরা পড়ে না। কখনো-সখনো গা ছমছম করে উঠে; কারণটাও বুঝি না।মাঝেমধ্যে মন দ্রোহ করে, মাঝেমধ্যে হতাশা গ্রাস করে, কখনো বা বিষাদে ছেয়ে যায় মন। আমি তার কারণও জানতে পারি না। ১০ই অক্টোবর পূর্বপশ্চিম বিডি ডট নিউজ পোর্টালের রিপোর্টার ছন্নছাড়া, বেহিসেবি, বোহেমিয়ান উৎপল দাস নিখোঁজ হয়ে গেছে। থানায় জিডি করা হয়েছে দফায় দফায়। মন্ত্রী, পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, র‌্যাবের মহাপরিচালক সবাইকে বলা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত গরিব স্কুলশিক্ষক চিত্তরঞ্জন দাস সন্তনের কোনো খবর পাচ্ছে ন্,া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ শুনতে শুনতে বুক ভেঙে যায়। তার মা শয্যাশায়ী, বোনেরা কাঁদছে। সান্তনা দেয়ার ভাষা কারো জানা নেই। অসহায়ের মতো আমার আত্মাজুড়ে কেবল ক্রন্দন, আমাদের উৎপল ফিরে আসে না! উৎপল কোথায় কেমন আছে? এভাবে তরতাজা প্রাণবন্ত একটি সংবাদকর্মী যার কোনো বৈশ্বয়িক চিন্তাভাবনা নেই, ঘর-সংসার করার আকুলতা নেই, নেই পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা- এমন খামখেয়ালি একজন সংবাদকর্মী কেমন করে হারিয়ে যায়? তার সহকর্মীরা, সংবাদকর্মীরা, তাদের সন্তানরা প্রতিদিন জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি পর্যন্ত মানববন্ধন করে, প্রতিবাদ সভা করে! তবু রাষ্ট্র এই আর্তনাদের জবাব দেয় না। তবু রাষ্ট্র নাগরিকের সঙ্গে তার দেয়া অঙ্গীকার সংবিধান যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে তা পালনে এগিয়ে আসে না! প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সংবিধান বলেছে, জনগণই ক্ষমতার মালিক। এখানের জনগণের ক্ষমতা, নাগরিকের নিরাপত্তার বিধানে বারবার লঙ্ঘিত হয়। তবু না ফিরে আসে উৎপল, না তার জন্য রাষ্ট্রের কণ্ঠ উচ্চারিত হয়। মানুষের জীবন এমনিতেই ক্ষণস্থায়ী; তবু মানুষ তার মৌলিক অধিকার নিয়ে, বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে- জন্ম নেয়। একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উৎপল এভাবে হারিয়ে যাবে, এভাবে এক মাস ধরে নিখোঁজ হয়ে থাকবে। এটি ভাবলেই বুকের ওপর থাই পাহাড়ের মতো ভারী কিছু বুকে নেমে আসে, দম বন্ধ হয়ে আসে। আমাদের উৎপলকে ফিরে চাই, ফিরিয়ে দাও? এমন করে চিৎকার দিতে গিয়ে যেন থেমে যাই। কণ্ঠ কি এক অদৃশ্য শক্তি চেপে ধরে। সামরিক জমানার অবসান ঘটলেও আজকের গণতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মী থেকে অসংখ্য মানুষ একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, গুম হয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে না। আদৌ ফিরে আসবে কি না, সেটিও জানি না। এরই মধ্যে উৎপলের আগে-পিছে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক মুবাশ্বার হাসান সিজার নিখোঁজ হয়ে গেছেন। গুলশানের বাসা থেকে সাদা পোশাকের লোকেরা প্রকাশনা ব্যবসায়ী তানভীন ইয়াসিন করিমকে তুলে নিয়ে গেছে। নিখোঁজ হয়েছেন নবগঠিত বিজেপি নেতা মিঠুন চৌধুরী ও আশিক ঘোষ। বহুল প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলোর খবরে বলা হয়েছে, গত আড়াই মাসে নিখোঁজ হয়েছেন ১০ জন। তাদের স্বজনদের পরিবারের সদস্যদের অবস্থা করুণ। দেশের যেকোনো নাগরিক অন্যায় অপরাধ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনি বিধিবিধান রয়েছে। আইনের আওতায় তাদের বিচারের মুখোমুখি করলে কোনো প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু যখন একেক জন তরতাজা মানুষ, তিনি শিক্ষক হোন আর সংবাদকর্মীই হোন, ব্যবসায়ী হোন আর রাজনৈতিক কর্মীই হোন; নিখোঁজ বা গুম হয়ে যান তখন উদ্বেগ উৎকণ্ঠাই বাড়ে না, লাখোকোটি মানুষের আর্তনাদ রাষ্ট্রযন্ত্রকে সজোরে আঘাত করে। আমাদের উৎপলদের আমরা কি আর ফিরে পাবো না? আমরা সুস্থভাবে উৎপল দাসকে ফিরে পেতে চাই। সব অধিকার বাদ দিয়ে হলেও এ আমাদের করুণ মানবিক আবেদন। উৎপলকে ফিরিয়ে দাও তার বাবা-মায়ের কোলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *