নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান কাল বুধবার যাচ্ছেন ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকে। ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (সিবিএ) নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন। এ সভায় যোগ দিতে বিভিন্ন শাখা কার্যালয়ের ১৮ নেতাকে যাতায়াত ও দৈনিক ভাতা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাঁদের বুধ ও বৃহস্পতিবারের সভায় অংশগ্রহণকে অফিসের কর্মসময় হিসেবেও গণ্য করা হবে। গতকাল সোমবার এ-সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ আদেশ জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যাকে নজিরবিহীন বলছেন ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘আমার ৫৪ বছরের কর্মজীবনে এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনিনি। শ্রমিক সংগঠনগুলো নিজেদের মতো কার্যক্রম চালাবে। এ জন্য আলাদা করে ভাতা দেওয়া, সভার সময়কে অফিস সময় হিসেবে গণনা করা—এটা কীভাবে সম্ভব! রীতিমতো অভিনব ঘটনাটি। এটা দিয়েই বোঝা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কোন দিকে যাচ্ছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই আদেশে বলা হয়েছে, ১৫ ও ১৬ নভেম্বর ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিবিএ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশগ্রহণের জন্য সিবিএ কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতাদের আসা-যাওয়াসহ ১৪-১৭ নভেম্বর অফিসের কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। এ সময় তাঁদের কর্তব্যকাল হিসেবে গণ্য হবে এবং বিধিমোতাবেক তাঁরা যাতায়াত ও দৈনিক ভাতা পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত সিবিএর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মোহাম্মদ মোস্তফাসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট, বরিশাল ও রংপুর অফিসের কর্মচারী নেতাদের এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সবাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিবিএ আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি-সম্পাদক। ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব বিষয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে অনুমোদিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, গভর্নর ফজলে কবির ও ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান সিবিএ নেতাদের এ সুবিধার নথিতে সই করেছেন। এরপরই তা কর্মচারী আদেশ হিসেবে জারি হয়েছে। তাঁদের দুজনকে কয়েক দফা মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে এবং বিষয়বস্তু লিখে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান জানান, তিনি ছুটিতে ছিলেন। আর অনুমোদন নথিতেও তিনি সই করেননি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মো. ইউনুসুর রহমান এ বিষয়ে কিছু জানেন না। গত রাতে তিনি মুঠোফোনে বলেন, ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এমন মতবিনিময় সভা কেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা এমনিতেই দুর্বল। রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগকে এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। এসব ব্যাংকে সিবিএর তৎপরতায় ঋণও যাচ্ছে। ফলে ব্যাংক খাতে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাত নিয়ে নৌমন্ত্রীর মতবিনিময় সভার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একাধিক ব্যাংকার বলেছেন, এমনিতেই ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব প্রকট। এর মধ্যে আবার যুক্ত হচ্ছেন নৌমন্ত্রী।
এ বিষয়ে জানতে গত রাতে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে সংস্থাটি। আর শক্তিশালী হয়ে উঠছে সিবিএ। কয়েক বছর ধরে সিবিএর সমাবেশে গিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন নৌমন্ত্রী। এ কারণে ব্যাংক খাতে আবারও উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন সিবিএ নেতারা।
আওয়ামী-সমর্থক এই সিবিএ নেতারাই ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা সহিদার রহমানকে বেধড়ক মারপিট করেছিলেন। এরপর তাঁদের কয়েকজনকে রাজধানীর বাইরে বদলি করা হয়। এখন আবার তাঁদেরই ভাতা দিয়ে সভায় অংশগ্রহণের জন্য আনা হচ্ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘এটা তো রীতিমতো বেআইনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজে এলে ভাতা পেতে পারেন। আর নৌপরিবহনমন্ত্রী ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার কে? আমার চাকরিজীবনে এমন ঘটনা শুনিনি।’ তিনি বলেন, ‘সব সময় দেখেছি, সিবিএ কলুষিত কাজে জড়িত। এরপরও তাদের এমন সুবিধা দিতে শুনিনি। হঠাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল, বোধগম্য হচ্ছে না।’
গত জুলাইয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ব্যাংকটির কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও এক অফিস সহকারীকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে ব্যাংকটি। এরপর গত ১৫ অক্টোবর রূপালী ব্যাংকে গিয়ে বহিষ্কৃত সিবিএ নেতাদের সঙ্গে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানান নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। ওই আলোচনায় শাজাহান খান বলেছিলেন, ‘গোড়ায় হাত দিলে অনেকের অনেক কিছু বের হয়ে যাবে। প্রধান বিচারপতির ঘটনা সবার জানা আছে। এ প্রতিষ্ঠানেরও অনেক কিছু বের হবে। সিবিএ নেতাদের সঙ্গে যে সমস্যা হয়েছে, তার সম্মানজনক সমাধান করুন।’
পরিবহন খাতের শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচিত নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। লম্বা সময় ধরে তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। শ্রমিকনেতা হিসেবে তিনি বেশি সমালোচিত হন ২০১১ সালে। ওই বছর মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন মারা যান। ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা’র দাবিতে পেশাজীবীরা দেশে তখন আন্দোলন গড়ে তোলেন। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে চাপা দেওয়া গাড়ির চালকের মুক্তি, যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার দাবিতে মালিক-শ্রমিক সমাবেশ করেন শাজাহান খান।
দেশে পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠার সময়ও শাজাহান খানের ভূমিকা নজরে পড়ার মতো। তাঁর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে গঠিত হয় ‘গার্মেন্ট শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। এরপর থেকে পোশাক খাতের সমস্যা সমাধানের বহু বৈঠক তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে করেছেন। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে আশুলিয়ায় বিভিন্ন যৌক্তিক দাবিতে পোশাকশ্রমিকেরা আন্দোলনে নামলে তা থামাতে তিনি ভূমিকা রাখেন। এবার তিনি যুক্ত হচ্ছেন ব্যাংক খাতে।