সৌদি আরবের মধ্যপন্থী ইসলামে ফিরতে চাওয়া কি শুধুই একটি মার্কেটিং কৌশল?

Slider সারাবিশ্ব

201116saudiarabia

 

 

 

 

সৌদ আরবের পরবর্তী রাজা উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান গত মঙ্গলবার ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি তার দেশকে ‘মডারেট ইসলাম’ বা মধ্যপন্থী ইসলামের দিকে ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু তার এই ঘোষণায় কেউ কেউ সন্দেহ করছেন, তেলের দাম কমে যাওয়ায় শুধু অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতেই এবং তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে সুবিধা লাভের জন্যই সৌদি যুবরাজ এই কৌশল নিয়েছেন।

ওই ঘোষণার পর অনেকের মধ্যেই এই আশা জেগে উঠেছে যে, অবশেষে চরম রক্ষণশীল সৌদি রাজতন্ত্র সেসব লোকদের কথায় কান দিচ্ছে যারা অনেকদিন ধরেই আরো স্বাধীনতা এবং সহনশীলতার কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু অনেকে আবার সাবধান করছেন এই বলে যে, ‘মধ্যপন্থী ইসলাম’ বলতে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আসলে কী বুঝাতে চাইছেন তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। এমনকি হতে পারে শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্যই একে একটা কৌশল হিসেবে নিয়েছেন যুবরাজ মোহাম্মদ।

লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পণ্ডিত মাদাবি আল-রাশিদ বলেন, সৌদি আরব এমন কোনো দেশ নয় যেখানে মধ্যপন্থী ইসলাম চরম রক্ষণশীল হয়ে উঠেছে। বরং এটি এমন একটি ব্যতিক্রম দেশ যেখানে ‘চরমপন্থী একটি ধর্মীয় মতবাদ রাষ্ট্রের অফিসিয়াল ধর্ম হয়ে উঠেছে। এবং ওই ধর্মীয় মতবাদ সৌদি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থারও টিকে থাকার ন্যায্যতার বয়ান বা আদর্শিক হয়ে উঠেছে। ’

মাদাবি আল-রাশিদ সাবধান করে বলেন, সৌদি আরব এর আগে এমন সব ধর্মতাত্ত্বিকদেরকে কারাদণ্ড দিয়েছে যারা ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর নতুনভাবে ব্যখ্যা করতে চেয়েছেন। উদারহণত যারা কোরআন-হাদীসের নতুনভাবে ব্যখ্যা করে ইসলাম এবং গণতন্ত্রের মিল দেখাতে চেয়েছেন তাদেরকে সহ্য করেনি সৌদি রাজতন্ত্র।

রাশিদ প্রশ্ন তুলেছেন, যুবরাজ ঘোষিত ওই ধর্মীয় সংস্কার পরিকল্পনা সত্যি সত্যিই বাস্তবায়ন করা হবে কি? তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় সংস্কারের ওই ঘোষণা আদতে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করার একটি প্রয়াস।

যেই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অনেক কুখ্যাতি আছে। ’

জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস এর সৌদি আরব বিশেষজ্ঞ সেবাস্টিয়ান সনস বলেন, ‘সৌদি আরবে একটি মধ্যপন্থী ইসলামের চেহারা কেমন হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু আমার মনে হয় মোহাম্মদ বিন সালমান এর মধ্য দিয়ে যে বার্তাটি প্রচার করতে চাচ্ছেন তা হলো, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনিও পশ্চিমাদের একজন বন্ধু এবং তিনিও একটি আধুনিক ভবিষ্যত চান। ’

৩২ বছর বয়সী বিন সালমান নিজেকে সৌদি আরবের তরুণদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতেও চেষ্টা করেছেন। যারা আগের প্রজন্মের চেয়ে একটু কমই ধার্মিক এবং যাদের মধ্যে বেকারত্বের হারও অনেক বেশি।

আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা আইএমএফ হুঁশিয়ারি দিয়েছে, বিশ্বব্যাপী তেলের দাম ৫০% কমে আসায় চলতি বছরের মধ্যেই সৌদি আরবের অর্থনীতি বন্ধ্যাবস্থায় নিপতিত হতে চলেছে। এতদিন সৌদি আরবের অর্থনীতি মূলত তেলের উচ্চ মূল্যের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। দেশটির রাজস্বের সিংহভাগই আসত তেল বেচার টাকা থেকে। কিন্তু হঠাৎ করেই তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় তিন বছর আগে সৌদি নেতৃত্ব খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনার তাগিদ বোধ করেন।

সৌদি আরবের ধর্মীয় চরমপন্থীরাও এই ধরনের সংস্কার পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হতে তীব্র চাপের মুখে পড়েন। কেননা সৌদি রাজতন্ত্র উত্তোরত্তর অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হচ্ছিল।

যদি এই সংস্কার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় তাহলে সৌদি রাজতন্ত্র কপর্দক শুন্য হয়ে পড়বে। আর এতে সৌদি রাজতন্ত্রের নেতৃত্বের জন্য ব্যাপক রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হবে। যেখানকার বিশাল সংখ্যক মানুষেরই কর্মসংস্থান হয়েছে রাষ্ট্র কর্তৃক এবং অনেকেই শুধু রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি বা ভাতার ওপর বেঁচে আছেন।

দশকের পর দশক ধরে সামাজিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তনে রাজি হতে না চাওয়ার পর এখন এসে মনে হচ্ছে সৌদি আরব দুটি পরিবর্তনেই রাজি। অন্তত মৌখিকভাবে হলেও।

জার্মান বিশেষজ্ঞ সেবাস্টিয়ান সনস বলেন, ‘তার মানে এই নয় যে সৌদি আরব পুরোপুরি একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে যেখানে নানা ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষরা সমান অধিকার নিয়ে সহাবস্থান করতে পারবেন। এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না যে, ‘শিয়াদের বিরুদ্ধে চলমান রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ হবে, বা দেশটির নারীদের ওপর ধর্মীয় ও পুরুষতান্ত্রিক খবরদারির সিস্টেম বন্ধ হবে। ’

সেবাস্টিয়ান সনস বলেন, ‘যদিও দেশটিতে গোঁড়া ধর্মতাত্বিকদের প্রভাব ১০-১৫ বছর আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে এবং সংস্কার পরিকল্পনার বিষয়েও তারা চুপ আছেন তথাপি আমি কল্পনাও করতে পারছি না যে যুবরাজ মোহাম্মদ ধর্মতাত্বিকদের সঙ্গে রাজতন্ত্রের সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করার ঝুঁকি নেবেন। ’

আর শিয়াদের ওপর চলমান নিপীড়ন এবং ইরানবিরোধী মনোভাব জারি রাখার মধ্য দিয়ে হয়তো চরমপন্থী ওহাবি ধর্মতাত্বিকদেরকে শান্ত রাখা যাবে। এছাড়া জনগনও হয়তো গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে এ ব্যাপারে মুখ খুলবে না।

তবে ‘শুধু নারীদেরকে গাড়ি চালানোর বা বিকিনি পরার অনুমতি দিলেই ইসলামের সংস্কার সধন হয়ে যায় না’, বলেন, লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পণ্ডিত মাদাবি আল-রাশিদ।

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *