পানি সংরক্ষণ এলাকার এক–তৃতীয়াংশ হাওয়া

Slider বিচিত্র

db9f0a9bcd9a003f40fd948bde9a4f50-59f1c1d8cc008

 

 

 

 

ঢাকাকে পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর করতে ২০০৪ সালে রাজধানী ও এর আশপাশে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কাজ শুরু করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। টানা বা ভারী বৃষ্টির কারণে নালা-নর্দমা ও খাল ভরে যাওয়ার পর অতিরিক্ত পানি সাময়িকভাবে ধরে রাখতে ড্যাপ এলাকায় ৫ হাজার ৫২৪ একর জলাভূমিকে পানি সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখান থেকে পরে অতিরিক্ত পানি প্রাকৃতিক নিয়মে অথবা সেচযন্ত্রের মাধ্যমে নদীতে ফেলার কথা বলা হয়। ২০১০ সালে ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী আবাসন কোম্পানিগুলোর চাপে পরে অবশ্য এটি পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি করা হয়।

জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা জাইকার পৌরসভার কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের নগর পরিচালন ও অবকাঠামোবিষয়ক পরামর্শক মো. আসাদুজ্জামান বলছেন, নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে এর ১২ শতাংশ জলাধার বা রিটেনশন এরিয়া থাকতে হবে। এই এলাকাগুলো ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানে (ফ্যাপ-৮ এ ও ফ্যাপ-৮ বি) নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। পরে তা ড্যাপে সংযোজন করা হয়।

২০১০ সালের ড্যাপ অনুযায়ী, রাজধানীর পশ্চিমাংশে কল্যাণপুর এলাকায় ২৩৩ একর জায়গায় এবং গোড়ান-চাটবাড়ি এলাকায় ৬৩২ একর জায়গায় দুটি পানি সংরক্ষণ এলাকা নির্ধারণ করা হয়। ঢাকার পূর্বাংশে উত্তরখান এলাকায় ৬২০ একর, বড় বেরাইদ ও বড় কাঁঠালদিয়া এলাকায় ৯৪৯ একর এবং গজারিয়া এলাকায় ১ হাজার ১০৮ একর জায়গা পানি সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে সরকারের একাধিক সংস্থা, ব্যক্তিমালিকানাধীন ও খাসজমি রয়েছে।

নির্ধারিত এই পানি সংরক্ষণ এলাকার মধ্যে এখন কোথায় কত একর জায়গা অবশিষ্ট আছে বা কী অবস্থায় আছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি রাজউক। জানতে চাইলে রাজউকের উপনগর-পরিকল্পনাবিদ ও নতুন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, নতুন ড্যাপ তৈরির জন্য মাঠপর্যায়ে দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তারা খসড়া প্রতিবেদন দিয়েছে। সে অনুযায়ী রাজউক কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে এগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে।

তবে ওয়াসা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বাস্তবে ঢাকার পশ্চিমাংশে কল্যাণপুরে ২৩৩ একরের স্থলে ১৭১ দশমিক ৬২ একর, গোড়ান-চাটবাড়ি এলাকায় ৬৩২ একরের স্থলে ৫৯২ একর জায়গা অবশিষ্ট আছে। বাকি জায়গা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। রাজধানীর পূর্বাংশে বড় বেরাইদ ও বড় কাঁঠালদিয়া এলাকার ৯৪৯ একরের পুরোটাই ভরাট করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে প্রবাভশালী একাধিক আবাসন কোম্পানি।

উত্তরখানের ৬২০ একর এবং গজারিয়া এলাকার ১ হাজার ১০৮ একর পানি সংরক্ষণ এলাকা এখনো অক্ষত আছে বলে সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করছে।

বিমানবন্দর সড়কের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরকে পূর্ব-পশ্চিম দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, এই জলাধারগুলো সংরক্ষণ করতে না পারা বড় ধরনের অশনিসংকেত। পানি সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটলে খাল ও নালা উপচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে থাকবে। কোনো পরিকল্পনাই তখন আর কাজে আসবে না।

২০১০ সালের ড্যাপে বলা হয়েছে, ড্যাপের পরিকল্পনা অক্ষুণ্ন রাখার দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বললেন, ড্যাপে যেসব এলাকাকে পানি সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব এলাকা সেভাবেই থাকার কথা। তবে এগুলো দেখাশোনা করার দায়িত্ব রাজউকের নয়। দায়িত্ব তাহলে কার—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ওয়াসার এলাকাভুক্ত হলে ওয়াসার, নয়তো বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের।

রাজউকের চেয়ারম্যানের এ বক্তব্যের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বললেন, এগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব যদি রাজউকের না হয়, তবে এ প্রতিষ্ঠানের দরকার কী?

কল্যাণপুর এলাকা : কল্যাণপুরের পানি সংরক্ষণ এলাকাটি দেখভাল করে ঢাকা ওয়াসা। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর এলাকা বন্যামুক্ত করতে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধের ভেতরের পানিনিষ্কাশনের জন্য কল্যাণপুর খালের শেষ মাথায় জাপান সরকারের অর্থায়নে প্রতি সেকেন্ডে ১০ ঘনমিটার ক্ষমতার একটি পাম্প বসানো হয়। ২০০৬ সালে জাইকা ওই এলাকায় একটি সমীক্ষা চালায় এবং আবার জাপান সরকারের অর্থায়নে ১০ ঘনমিটার ক্ষমতার আরও একটি পাম্প বসানো হয়। জাইকা বাংলাদেশ সরকারকে পাম্পের সামনের এলাকায় সাময়িকভাবে পানি ধরে রাখার জন্য ২৪৭ একরে ‘ওয়াটার রিটেইনিং পন্ড’ তৈরি করার পরামর্শ দেয়। ২০১০ সালের ড্যাপে সেখানে ২৩৩ একর জায়গা চিহ্নিত করা হয় পানি সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু এখন সেখানে জমি আছে ১৭১ দশমিক ৬২ একর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, ২৪৭ একরের সুপারিশ থাকলেও বাস্তবতা বিবেচনা করে সেখানে ২২৭ একর জায়গায় ওয়াটার রিটেইনিং পন্ড তৈরির পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যে বিএডিসির জমি ছিল ৯৮ দশমিক ৩৫ একর, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬ দশমিক ৩৬ একর, ওয়াসার ৯ দশমিক ৭১ একরের সঙ্গে আরও ১১২ দশমিক ৬ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৫৭ দশমিক ০২ একর জমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়।

এখন ওয়াসার দায়িত্বে থাকা ১৭১ দশমিক ৬২ একর জমিরও কিছু অংশ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করেছে বলে জানিয়েছেন ওই পাম্পস্টেশনে কর্মরত ব্যক্তিরা।

জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ওখানে জায়গা কমে যাওয়ায় সেখানকার গভীরতা বৃদ্ধি করে সমপরিমাণ পানি ধরে রাখার ক্ষমতা নিশ্চিত করা হবে। সেখানে আরও ১৬ ঘনমিটার প্রতি সেকেন্ড ক্ষমতার আরও একটি পাম্প বসানো হবে। এ ব্যাপারে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

গোড়ান-চাটবাড়ি এলাকা : বর্ষা মৌসুমে পল্লবী, মিরপুর, ক্যান্টনমেন্ট ও উত্তরা এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানের (ফ্যাপ-৮ বি) সমীক্ষায় গোড়ান-চাটবাড়ি এলাকায় প্রতি সেকেন্ডে ৬৫ দশমিক ২০ ঘনমিটার ক্ষমতার পাম্প বসানো ও সেখানে ৬৮৬ একর জায়গাকে পানি সংরক্ষণ এলাকা করার সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ অনুযায়ী, দুই ধাপে ৪৪ ঘনমিটার ক্ষমতার দুটি পাম্প বসানো হয়। ড্যাপে এখানে ৬৩২ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত এ এলাকাটি দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু ইতিমধ্যে এই এলাকার উত্তর দিক থেকে ৪০ একর জায়গা ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’র জন্য ছেড়ে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই ৪০ একরের প্রায় পুরোটাই ভরাট হয়ে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য পানি সংরক্ষণ এলাকার ৪০ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৪০ একর জায়গা কমে যাওয়ায় সেখানে প্রতি সেকেন্ড ২২ ঘনমিটার ক্ষমতার একটি পাম্প বসানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই পাম্প বসানোর খরচ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প থেকে নেওয়া হবে।

বড় বেরাইদ ও বড় কাঁঠালদিয়া এলাকা : ২০১০ সালে ড্যাপে এই এলাকার ৯৪৯ একর জায়গা পানি সংরক্ষণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু পরে আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে ড্যাপ সংশোধন কমিটি জমিটির শ্রেণিই বদলে ফেলে। এখন এলাকাটি আবাসিক এলাকার শ্রেণিভুক্ত। এরপর রাজউক এখানে আবাসিক ভবন তৈরির অনুমতি দিলে পুরো এলাকা ভরাট করে ফেলে প্রভাবশালী আবাসন কোম্পানিসহ অন্যরা।

অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, পানি সংরক্ষণ এলাকা কমে গেলে বা না থাকলে রাজধানীর পূর্ব ও পশ্চিম অংশের অবস্থা ডিএনডি এলাকার মতোই হবে। যেখানে সারা বছরই ঘরবাড়ি হাঁটুপানিতে ডুবে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *