মা-হারা শিশু হাতির হামলা, নিহত ১

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

f7f9b340d9a1310c0076005d29d55f8a-59e4cb8dd5748

 

 

 

 

পোষা হাতি নূরজাহানের পাঁচ বছরের ছেলে বাহাদুর জন্মের পর থেকেই তার কাছেই থাকত। হাতির মালিক বাহাদুরকে এ বয়সেই কাজে নামাতে চান। তাই মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে তাকে নিবিড় প্রশিক্ষণ (স্থানীয় ভাষায় ‘হাদানি’ অনুষ্ঠান) দেওয়া দরকার। কিন্তু এ কাজটি বেশ কঠিন। এরপরও দুজনকে আলাদা করতে হয়। এটা প্রায় ১০ মাস আগের ঘটনা। প্রশিক্ষণ শেষে বাহাদুর মায়ের কাছে ফিরে যায়। তবে কারও ক্ষতি যাতে না করে, মাহুত (হাতি দেখাশোনাকারী ব্যক্তি) রাতে তার পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। সকালে তা আবার খুলে দেন। আজ সোমবার সকালে মাকে আশপাশে না দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে বাহাদুর। একপর্যায়ে শিকল ছিঁড়ে মাকে খুঁজতে লোকালয়ে চলে আসে। এ সময় তার ধাক্কায় এক চা-শ্রমিক বৃদ্ধা মারা যান।

ঘটনাটি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের রত্না চা-বাগানের পরি বস্তি এলাকায় ঘটে। নিহত শ্রমিক একই এলাকার বাসিন্দা সুবল উরাংয়ের স্ত্রী মানদা উরাং (৫৫)। নূরজাহান ও বাহাদুরের মালিক উপজেলার সদর জায়ফরনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাছুম রেজা।
এর আগে এই জুড়ীর গোয়ালবাড়ীতে ও কুলাউড়ার মেরিনা চা-বাগানে দুই দফায় পোষা হাতির আক্রমণে দুজন প্রাণ হারায়। পোষা হাতির রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির কারণেই এভাবে একের পর এক প্রাণ যাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন। বিপন্ন এক প্রাণীকে দিয়ে ব্যবসার কাজে লাগানোর সমালোচনা করেছেন প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা।
এলাকাবাসী ও হাতির মালিকের সূত্রে জানা গেছে, এ এলাকায় পোষা হাতিদের গাছ টানানোর কাজসহ সার্কাসে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত বাহাদুরের প্রশিক্ষণ চলে। বর্তমানে সে ও তার মা সাগরনাল সংরক্ষিত বনে বিচরণ করে। আজ দুপুর ১২টার দিকে বাহাদুর পার্শ্ববর্তী রত্না চা-বাগানের পরি বস্তিতে ঢুকে পড়ে। এ সময় লোকজন আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। মানদা উরাং বাড়ির পাশে একটি কুয়া থেকে পানি তুলে থালা-বাসন পরিষ্কার করছিলেন। হঠাৎ বাহাদুর এসে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। খবর পেয়ে বেলা দেড়টার দিকে হাতির মালিকপক্ষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সেখানে যান।
গোয়ালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নিহত মানদার শরীরে কোনো আঘাত দেখা যায়নি। রত্না বাগানের হাসপাতালের চিকিৎসক গিয়ে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছেন, হাতির ধাক্কায় ভয়ে ওই শ্রমিক (মানদা) স্ট্রোক করতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘হাতির মালিকপক্ষ ওই শ্রমিকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া খরচপাতি দেবে। এ ছাড়া আমরাও তাৎক্ষণিক তাঁর পরিবারকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেছি। বিষয়টি মিটমাট হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কারও কোনো অভিযোগ নেই।’
হাতির মালিক মাছুম রেজা যুক্তরাজ্যে থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মাছুমের ছোট ভাই নিপার রেজা বলেন, ‘রাতে মাহুত বিশ্রামে থাকেন। আশপাশের লোকজনের যাতে ক্ষতি না করতে পারে, সে জন্য ওই সময় বাহাদুরকে বেঁধে রাখা হয়। সকালে মাকে না দেখতে পেয়েই সে (বাহাদুর) রাগে শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ে বলে আমরা ধারণা করছি। তবে দুর্ঘটনার পর তাকে আবারও শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়।’
নিহত মানদার স্বামী সুবল বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা গিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কারও বিরুদ্ধে তাঁদের আর কোনো অভিযোগ নেই।
এর আগে দুই দফায় হাতির আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও ‘মিটমাট’ হয়ে গেছে। কারও কোনো সাজা হয়নি। এভাবে একের পর এক হাতির আক্রমণ প্রমাণ করে হাতির মালিকেরা রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীন—এমন মন্তব্য নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান মো. জাকারিয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাতি প্রাণীটি বিপদাপন্ন। এটিকে পোষার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। হাতির স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এভাবে।’ হাতিকে দিয়ে ব্যবসার কাজে লাগানোর সমালোচনা করেন তিনি।
তবে ব্যক্তিপর্যায়ে হাতি পালন বা সার্কাস, গাছ টানার কাজে তাকে লাগানোর ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই বলে জানান সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্য প্রাণী) মিহির কুমার দো। তিনি বলেন, ‘নীতিমালায় হাতি পোষা বা তাকে দিয়ে কাজ করানোর কথা আছে। কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো হয় না। এ জন্য মালিকদের আমরা বারবারই সাবধান করি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *