.
হাফিজুল ইসলাম লস্কর :: এক সময় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিলো চিঠি। আর সেই চিঠি পাঠাতে হতো ডাকযোগে। কালের অগ্রযাত্রায় ঐতিহ্যের স্মারক ডাকঘরের ব্যবহার দিন দিন কমে এসেছে। সেই সাথে বাড়ছে ডাককর্মীদের দৈন্যদশা। ডাক কর্মীদের জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে কবি সুকান্তের ভাষায় “রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে, রানার ছুটেছে খবরের বোঝা হাতে-”।
ফলে বাড়ছে ডাক ঘরের অযত্ন। অবহেলা আর অযত্নে কালের সাক্ষী হয়ে সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সিলেট নগরীর তাঁতিপাড়াস্থ পোস্ট অফিসটি।
ব্যস্ত নগরীর ব্যস্তাতার ভিড়ে এখন আর কারো চোখে পড়ে না এই পোস্ট অফিসটি। প্রয়োজন ফুরিছে তাই কেউ আর খোঁজ নেন না। এমনকি নিজ এলাকায় ডাকঘর রয়েছে অনেকে সেটাও জানেন না। ঠিক তেমন একটি ডাকঘর সিলেট নগরীর তাঁতীপাড়ায় অবস্থিত। জরাজীর্ন ছোট একটি চার দেয়ালের ঘরে চলছে ডাকঘরের কার্যক্রম। ডাকঘরটি রাস্তার পাশে থাকলেও এমন একটি অবস্থানে রয়েছে খুব ভালভাবে খেয়াল না করলে সেটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভিতরের অবস্থাও খুবই করুন। একটি মাত্র টেবিল আর একজন মাত্র বসার জায়গা নিয়েই পুরো ডাকঘরটি।
যেখানে শহরের একটি ব্যস্ততম এলাকা জিন্দাবাজার লাগোয়া সড়কেই তাঁতীপাড়া ওই জায়গাতেই খুব ভালভাবে খেয়াল না করলে ডাকঘরটি খুঁজে পাওয়া যায় না সেখানে অন্যান্য এলাকার মানুষ এসে কিভাবে সেবা গ্রহন করবে সেটা একটি বড় প্রশ্ন। এমনকি সংস্কারেও নেই কোনো উদ্যোগ যেখানে ডাকঘর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটার বাহ্যিক দূরবস্থা নিয়েও জনমনে উঠছে নানান প্রশ্ন।
তাঁতীপাড়াতে অবস্থানরত ডাকঘরটি আগে নগরীর নয়াসড়কে অবস্থিত ছিল। তবে সেখানে ওই ডাকঘরটি তেমন একটা ব্যবহৃত না হওয়াতেই তাঁতী পাড়ায় এসে নয়াসড়ক শাখার নামেই স্থানান্তরিত হয়। কোন ধরনের ভাড়া ছাড়াই ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি মার্কেটের চতুর্থ তলায় জায়গা দিলেও পরে ক্রমান্বয়ে তিন বারের বেশী সময়ে স্থান পরিবর্তন করে এখন রাস্তা লাগোয় জরাজীর্ণ একটি ছোট কক্ষে অবস্থান নিয়ে তার কার্যক্রম চলছে।
ডাকঘরের এক্সটা ডিপার্টমেন্টাল সাব পোস্টমাস্টার ফারুক আহমদের সাথে কথা বলে জানা যায় ডাকঘরের দু:খ দুর্দশার করুন চিত্র।
দীর্ঘ ২২ বছর ধরে ইডিএসপিএম (এক্সটা ডিপার্টমেন্টাল সাব পোস্টমাস্টার) হিসেবে এই ডাকঘরের সাথে কাজ করে আসছেন ফারুক আহমদ। তিন ছেলে ও স্ত্রীসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। দিনের অর্ধেক সময়ই পার করেন ডাকঘরে। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২-৩টাতে কাজ করে বাড়িতে ফেরেন। অথচ মাস শেষে এই কাজের জন্য তার সম্মানী মেলে মাত্র তিন হাজার টাকা। এমনকি বছরের দুই ঈদেও পান না কোন ভাতা। অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত তিনি।
শুধু তিনিই নন এইরকম আরও ২৩ হাজার ইডি কর্মী অবহেলিত ভাবে দিন কাটাচ্ছেন নূন্যতম সম্মানী আর কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা ছাড়াই। ফলে সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেছে নিতে হচ্ছে অন্যান্য পেশা। ফলে এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটিতেই দেখতে হচ্ছে ক্ষতির মুখ।
ডাকঘরের বিষয়ে পোস্টমাস্টার ফারুক আহমদ বলেন, ১৯৯৫ সাল থেকেই কাজ করছি এটার সাথে। ৬০০ টাকার সম্মানী থেকে বেড়ে এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩শ টাকায়। এমনকি ডাকঘরের অবস্থাও খুব খারাপ। মানুষ আসে না। তার মধ্যে ভাড়াবিহীন আরেকজনের দেয়া জায়গাতেই ডাকঘরের কাজ করতে হচ্ছে। এর আগে এই মার্কেটের মালিক একটা বড় জায়গা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে ওই জায়গায় মার্কেটের মালিকের সমস্যা হওয়ার জন্য আবার পরিবর্তন করে এই ছোট্ট একটি কক্ষে আসতে হয়েছে। ডাকঘরের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই।
দূর থেকে কারো চোখে পড়লে প্রথমে কিছু বুঝে উঠার আগেই মনে হবে কোনো কিছুর গোদাম এই জায়গাটি। ডাকঘর বলে বোঝাই যায়না।
তাঁতীপাড়ার এই ডাকঘরটিতে রেজিস্ট্রি চিঠিপত্র ইস্যূ করা হয়। এছাড়াও এলাকার কয়েকজন মানি অর্ডার দিতে আসে তাও সংখ্যায় তা অনেক কম।
ফারুক বলেন, জায়গার এখন অনেক মূল্য। অন্যের মালিকানাধীন জায়গাতেই রয়েছে ডাকঘরটি। সকাল ১১ টা থেকে ৪ ঘন্টা কাজ করার সময়সূচী আমার। আগে প্রচুর কাজ ছিল। কোনোদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। এতদিন এত কষ্টের পরেও আমরা এখনও অবহেলিত। কোন সুযোগ সুবিধা পাই না আমরা।
এখন বিশ্বায়নের যুগ। মোবাইল ইন্টারনেট আর কম্পিউটারে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়। যার ফলে চিঠি আদান প্রদানের প্রয়োজনীয়তাও এখন ফুরিয়ে গেছে। এক ক্লিকে যোগাযোগ করা যাচ্ছে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় যে কোনো প্রান্তে। এমন অবস্থায় ডাকঘরে গিয়ে চিঠির আশার কেউ করে না।
ফারুক বলেন, এই যুগে এখন আর কেউ চিঠির আশা করে না। অফিসিয়াল কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে ডাকঘরের বেশীর ভাগ কার্যক্রম। ২০০৭ এর দিকে প্রতিটি ডাকঘরে প্রদান করা হয় মোবাইল ও সীমকার্ড। যা দিয়ে প্রতি মিনিট দুই টাকায় কথা বলার সুযোগ দেয়া হবে এসব অবিভাগীয় ডাকঘরে। তবে সেই কাজেও তেমন সারা মিলেনি বলে জানান ফারুক আহমদ।
তিনি বলেন, আগে একটা সময় সবার কাছে মোবাইল ছিল না। তাই বাইরে এসে কল করতেন। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। প্রত্যেকের হাতেই এখন মুঠোফোন রয়েছে। এখন ১০০০ টাকা মোবাইলে রিচার্জ করালে তাতে লাভ হয় ২৮ টাকা। তার মধ্যে এখানে এসে তেমন কেউই নেই কথা বলার। এখনও ওই সময়ের প্রদত্ত মোবাইল ও সীমকার্ডটি আমার কাছে সচল রয়েছে।
ডাককর্মিদের আন্দোলন।
এদিকে ইডি কর্মচারীদের ভাতা বৃদ্ধিতে অনেক আগে থেকেই দাবী জানিয়ে আসছেন তারা। এমনকি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী তারানা হালিম এসব দাবী মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও এখনও এসব ইডি কর্মচারীরা বাতিলের কাতারে রয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন ইডি কর্মচারী ফারুক।
দাবীর বিষয়ে ফারুক বলেন, আমাদের ইডি কর্মচারীদের সর্বোচ্চ ভাতা ৩ হাজার ৩শ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাতা প্রদান করা হয় ২ হাজার ২শ ৬০ টাকা। যা দিয়ে এক সপ্তাহ চলার মতই সংস্থান হয় না। যা ভাতা আমরা পাই তা যাতায়াতেই চলে যায়। আর এভাবেই চলছে। আমরা খুব কষ্টে আছি।
এদিকে, ইডি কর্মচারীদের সাত দফা দাবীতে বাংলাদেশ পোস্টাল ই ডি কর্মচারী ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিলেও এখনও কোন সুযোগ সুবিধার আওতায় আনা হয় নি তাদের। বিভিন্ন সময় মানববন্ধন কর্মসূচীও পালন করেন তারা।
বাংলাদেশ পোস্টাল ই.ডি. কর্মচারী ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, ই.ডি.এস.পি.এম (ই.ডি সাব-পোস্ট মাস্টার) পদে কর্মরত রয়েছেন ৩২২ জন যাদের বর্তমান প্রদত্ত ভাতা ৩ হাজার ৩শ টাকা, ই.ডি.এ( ব্রাঞ্চ পোস্ট মাস্টার) পদে কর্মরত রয়েছেন ৮১৩৮ জন যাদের বর্তমান প্রদত্ত ভাতা ২ হাজার ৫শ ২০ টাকা, ই.ডি.ডি.এ (চিঠি বিলিকারী) কর্মচারীর সংখ্যা রয়েছে ৭২৩৫ জন, ই.ডি.এম.সি (ডাক বহনকারী) কর্মচারীর সংখ্যা ৫৯৬১ জন যাদের বর্তমান প্রদত্ত ভাতা ২ হাজার ৩শ ৬০ টাকা, অন্যান্য ই.ডি কর্মচারী (চৌকিদার, ঝাড়–দার) কর্মচারীর রয়েছেন ১৩৪৭ জন যাদের বর্তমান প্রদত্ত ভাতা ২ হাজার ২শ ৬০ টাকা।
বাংলাদেশ পোস্টাল ই.ডি কর্মচারী ইউনিয়ন এর সভাপতি শাহ নেওয়াজ চৌধুরী বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়েই দাবী আদায়ে কর্মসূচী পালন করেছি। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী মাসের ২২ তারিখ থেকে এক সপ্তাহের জন্য আমরা কার্যক্রম স্থগিত রাখব। আর ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি সকলেই।
.
বার্তা প্রেরক
হাফিজুল ইসলাম লস্কর