দুর্নীতি উপাচার্যের, দায় রাজনীতিকের?

Slider রাজনীতি

940f456d6cc387eabba723144ea260fd-59db4baec1340

 

 

 

 

 

৬ ও ৭ অক্টোবর বগুড়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দুদিনব্যাপী জাতীয় শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কৌশলবিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় অনেক উপাচার্য বলেছেন, রাজনৈতিক চাপে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি হয়। উপাচার্যদের এ কথা ভয়াবহ। কেউ তো অস্ত্রের মুখে উপাচার্যকে দুর্নীতি করতে বাধ্য করেনি। একজন উপাচার্য যদি দুর্নীতি করতে না চান, তাহলে তাঁকে কেউ দুর্নীতি করাতে বাধ্য করতে পারেন না। বরং দুর্নীতি অন্যের কারণে হয়—এ কথা বলার মধ্য দিয়ে উপাচার্যদের দুর্নীতি করার পথ প্রশস্ত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার জন্য যখন ব্যক্তিত্ব-আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হন্যে হয়ে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ছুটে বেড়ান, তখনই তাঁর নীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যখন উপাচার্য তাঁর আত্মীয়-স্বজন বাড়ির কাজের ছেলে-মেয়ে-গাড়িচালকদের নিয়োগ দেন, তখন কোন রাজনৈতিক শক্তি তাঁদের বাধ্য করে, তা আমাদের জানা নেই (!)। যখন একজন উপাচার্যের আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর আমাদের শুনতে হয়, তখন কোন রাজনৈতিক চাপ থাকে, তা আমরা জানি না (!)।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য একটি নিয়োগ বোর্ড থাকে। এই নিয়োগ বোর্ড গঠনের সময়ে উপাচার্যরা নিজেদের পছন্দমতো অধিকাংশ সদস্য নির্বাচন করেন। রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তি এই বোর্ড সদস্য নির্বাচন করেন না। উপাচার্য যদি সদস্যদের অনুরোধ করেন এবং নিজেও সচেষ্ট থাকেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন, তাহলে অন্যায় হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। বরং দুর্নীতিপ্রবণ উপাচার্যরা এমন সদস্যদের দিয়ে বোর্ড গঠন করেন, যাতে নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতার পথ প্রশস্ত হয়।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্য একবার পত্রিকায় লিখেছিলেন, তিনি একটি জানাজায় গিয়েছিলেন, সেখানেও নিয়োগের তদবির নিয়ে এসেছিলেন কেউ কেউ। যত দূর জেনেছি, তিনি তাঁর মেয়াদকালে কোন মন্ত্রী-সাংসদ-আমলার কথায় একজনকেও নিয়োগ দেননি। সেই উপাচার্যকে বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়েছিল। এই দৃষ্টান্ত তো উপাচার্যের ন্যায় কাজের পুরস্কার। উপাচার্যরা যদি বাধ্য হন রাজনৈতিক চাপে অপরাধ করতে, তাহলে তো তাঁদের উপাচার্য পদটি ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অনেক বড় পদ উপাচার্য। একই সঙ্গে তাঁরা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধান। এ রকম স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি অসহায়ত্ব বোধ করেন, তাহলে সরকারি চাকরিজীবীদের তো করুণ অবস্থা হওয়ার কথা। যে প্রতিষ্ঠানের আচার্য রাষ্ট্রপতি, সেই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে কোনো রাজনৈতিক চাপের কাছে নত হওয়া চলে না। একজন উপাচার্যের প্রধানতম যোগ্যতাই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করায় কোথাও নত না হওয়া। তা না হলে শিক্ষার্থীরা কী শিখবেন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে?

রাজনৈতিক চাপ এড়ানো না গেলে উপাচার্যরা এ প্রস্তাব করুন যে নিয়োগের ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে থাকুক। এ কথা উপাচার্যরা বলবেন না। বরং নিয়োগের ক্ষমতা না থাকলে বর্তমান যাঁরা উপাচার্য আছেন, তাঁদের অনেকেই উপাচার্য পদে থাকতে চাইবেন না।

শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কৌশলবিষয়ক ওই সভায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন, ‘চার মাস আগে উপাচার্য পদে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে অনেক চ্যালেঞ্জে পড়েছি। আমার বাসায় ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে সবখানে চাকরি প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্তের ছড়াছড়ি। রাজনৈতিক তদবির থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদের সচিবেরা পর্যন্ত প্রার্থী নিয়োগে সুপারিশ করছেন। এভাবে চললে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব?’ আমি যত দূর জানি, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ উপাচার্য হওয়ার জন্য কোথাও তদবির করেননি। সরকার তাঁকে পছন্দ করেই দায়িত্ব দিয়েছে। তিনি তদবিরের চাপে আছেন। শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কঠিন বলে উল্লেখ করেছেন। আমি মনে করি, তিনি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কোনো রাজনৈতিক চাপের কাছে নত হবেন না। ‘চ্যালেঞ্জ’-এ তিনি জিতবেন।

একজন উপাচার্য যদি দুর্নীতি করার ইচ্ছে পোষণ করেন, তাহলে তিনি উপাচার্য পদে যোগদান করেই দুর্নীতিপ্রবণ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পাশে নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের পদগুলো বণ্টনের বেলায় যোগ্যতার পরিবর্তে অন্ধ আনুগত্যকে প্রাধান্য দেন। মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে ভোটার নিয়োগে সচেষ্ট হন। শিক্ষকদের বিভেদের রাজনীতিতে ঠেলে দেন।

একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলো যাতে সুস্থ ধারায় চলে, সে ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু যেসব উপাচার্য ব্যক্তিস্বার্থে ছাত্রসংগঠন ব্যবহার করতে চান, তাঁরা ছাত্রদের দিয়ে অন্যায় করান।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায় করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দায় আছে। তবে সেই দায় উপাচার্যকে বাধ্য করানো নয়। বরং একজন সৎ-কর্মঠ-নিষ্ঠাবান— যিনি উপাচার্য হওয়ার জন্য নিজের জীবনকে ওষ্ঠাগত করেন না, এ রকম ব্যক্তিকে উপাচার্য করতে না পারাটাই আমাদের ব্যর্থতা। উপাচার্যরা দুর্নীতি করলে তাঁদের সরকারিভাবে সতর্ক করা জরুরি। একজন উপাচার্য যদি দুর্নীতি করেন, তাহলে খবরের কাগজে প্রকাশিত হওয়ার আগে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তা সরকারের কাছে পৌঁছায়। প্রয়োজনে খবরের কাগজে প্রকাশিত হওয়ার আগেই তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন।

আমাদের দেশে উপাচার্যরা ব্যক্তিগত স্বার্থে বেশি দুর্নীতি করেন। রাজনীতিকের কাঁধে অস্ত্র রাখার স্বার্থে তাঁদের দু-একজন নিয়োগ দেন। কিছু হলেই সব সময় রাজনীতিকের ওপর দায় চাপান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কোনো কোনো উপাচার্য হরেক রকম দুর্নীতি করেন, যার কোনোটারই দায় রাজনৈতিক চাপের নয়। উপাচার্যের দুর্বল আত্মমর্যাদাবোধ এর জন্য দায়ী। যদি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি দুর্নীতি করাতে বাধ্য করতে চান, সরকার উপাচার্যের পাশে দাঁড়াবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর একান্তই যদি নীতির ওপর থাকা সম্ভব না হয়, তাহলে তিনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবেন। সেটাও তো সম্মানজনক। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত এ রকম দেখিনি।

শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কৌশলবিষয়ক সভায় প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেছেন, ‘কৃষকের ট্যাক্সের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে। উপাচার্যদের বেতন হয়। এ কারণে নিজেদের দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।’ এ বোধ সৃষ্টি হলে কোনো উপাচার্যই রাজনৈতিক চাপের কাছে হেরে যাবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *