‘ও বড় মানুষেরা, শুনতে পাওনি আমার চিৎকার?’

Slider নারী ও শিশু

6967f3c3b5204d89d9c4b3adda1e70de-59d758e481a77

 

 

 

 

যখন আপনারা নন, আমরাই বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার নয়ছয় নিয়ে হায় হায় করে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন, ঠিক তখনই ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে। মেরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘরের তাকে তুলে রাখা হয় ফেলে দেওয়া হবে বলে। ঘটনা গত রোববারের। কিন্তু আমরা অনেকেই খেয়াল করিনি। আমাদের মূল্যবান আবেগ, সময়, বুদ্ধি তখন অকাতরে খরচ হচ্ছে। আমাদের নাক চাইছিল সৌন্দর্যের বাজারে ব্যবসার নতুন মসলার ঘ্রাণ পেতে। হাওয়াই মিঠাই যেভাবে টেনে লম্বা করা হয়, তার থেকেও বেশি টানাটানি চলল খবরটা। কিন্তু গরিব ঘরের এই শিশুটির কথা কেউ বলল না। কলিজা কাঁপানো হাহাকার করে বেড়ালেন তার মা-বাবা। গণমাধ্যম ছাড়া বাস্তবতা জানা সহজ নয় আর। নেটওয়ার্কের মধ্যে না থাকলে একজনের মনের তরঙ্গ অন্য মানুষের মনের পর্দায় ধাক্কা দেয় না। বাস্তবতা এখন গণমাধ্যম পরিবেশন করে, তার মাধ্যমেই যা জানার তা জানি। জীবনযন্ত্রণা, জট আর হয়রানির এই দেশে আমরা হারিয়ে ফেলছি পায়ের তলার মাটি, পাশের মানুষের হাত। এ রকম বাস্তবতায় গণমাধ্যমের দৃষ্টি আর দর্শক-পাঠক-ফেসবুকারের মনোযোগের মূল্য অনেক বেশি। তাঁরা যা দেখান, তা আমরা যেমন দেখি, তেমনি আমরা যা চাই, চাপ তৈরি হলে তাঁরাও তা দেখাবেন।
চলতি সময়ে দেখা গেছে, ফেসবুকের প্রতিবাদ-শোরগোল গণমাধ্যমে এসেছে, গণমাধ্যমের চাপে সরকার-প্রশাসন নড়েছে। সেটা বনানীর ধর্ষণের ঘটনাই হোক, তনু-আফসানা-রূপা ধর্ষণ-হত্যার ঘটনাই হোক। অন্যদিকে দর্শক-পাঠক-ফেসবুকারদের বিনোদনের রেশমি জালে আটকে রাখার বন্দোবস্তও আছে। মৌ-লোভী পতঙ্গের মতো অনেকেই সেসব জালে আটকা পড়ি। বিশেষত তরুণদের অনেক মূল্যবান সময় ও তাজা আবেগ এই রশেবশে খরচ হয়ে যায়। বিনোদনের ওই রঙিন চশমার আড়ে কত কত সমস্যার পাহাড় যে ঢাকা পড়ে! যদি ঢাকা না পড়ত, তাহলে হয়তো আরেকটু ভালো দেশ আমরা পেতে পারতাম। ফেসবুক আমাদের গণনজরদারির সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু হায়, সেই গুরুত্ব, সেই নজর ওই নিহত শিশুটি পেল না।
এটা এমন এক যুগ, যখন বাস্তবের জ্বালাময় সমস্যার চেয়ে বিনোদন জগতের বাহারি মখমল অনেক বেশি টানে। এটা অনেকটা পলায়নও। রাস্তার জ্যামে আটকে থেকে, বিদ্যুৎহীন গরমে ঘামতে ঘামতে, ব৵ক্তিগত দুশ্চিন্তায় ভুগতে ভুগতে সত্যিই তো একটু জিরানোর দরকার হয়। বাস্তবে না পেয়ে আমরা হেলান দিই আকাশে—মানে অনলাইনে। কে হায় সর্বক্ষণ নেতিবাচক খবর পড়তে ভালোবাসে! বিনোদন জগতের হাওয়াই মিঠাই আমাদের একঘেয়েমি কাটানোর মলম; নিদারুণ বাস্তবতা থেকে পালানোর মায়াবী সুযোগ। ঝড় এলে উট পাখি বালুতে মুখ লুকায়, সামাজিক ঝড়ের সময় আমরা লুকাই বিভিন্ন রকম পর্দায়—টেলিভিশন-ট্যাব-মোবাইলে, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি।
গণমাধ্যম আজ বাসনা তৈরির কারখানা। মূলত হিন্দি স্যাটেলাইট চ্যানেল দিয়ে এসব আসছে। সেরের ওপর সোয়া সের হয়েছে ইউটিউব ভিডিও। হাতের মুঠোয় থাকা ফোনের মেমরিতে ইনস্ট্যান্ট নুডলের মতো ত্বরিত উত্তেজনার খোরাক। এই ভার্চুয়াল কামরূপ-কামাখ্যার চোখে কি শিশু কি বৃদ্ধা, সবাই বাসনা পূরণের বস্তু। দৃশ্য-বাস্তবের (Visual Reality) এই যুগে চোখ আক্রান্ত ও আক্রমণকারী দুটোই। চোখের দখল নেয় অবলোকনকামী পণ্য, তেমনি চোখ শিকারি হয়ে শিকার ধরে। চোখের নজর টেনে নিয়ে যেতে পারে বেপথে। ধর্ষণ এবং বিশেষ করে শিশুধর্ষণ যে বাড়ছে, তার সঙ্গে দৃশ্য-বাস্তবে আসক্ত চোখের সমস্যা জড়িত। তার সঙ্গে জনসংস্কৃতির যৌনায়নের গভীর আত্মীয়তা অনস্বীকার্য।

২.
গরিব ঘরের শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ফেসবুকে মেয়েটার নিথর মুখের দৃশ্য যতবার এসেছে, সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয় কি? সাত বছরের শিশু কী ভয়াবহ নির্যাতনে মরে যায়, তা কল্পনা করতে চাই না, পারি না, ভাবি না। ধর্ষণকে খুনের পরের অপরাধ ধরা হয়। কিন্তু শিশু ধর্ষণ কি খুনের চেয়ে বড় অপরাধ নয়? যে নির্যাতনে শিশুটি মরে যায়, সেই নির্যাতন মাপার কোনো ব্যারোমিটার মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। মাসুম বাচ্চাটির কথা মনে পড়লে হুহু করে ওঠে, প্রচণ্ড ক্রোধ জমা হয়। এই ক্রোধ সামলানোর উপায় দরকার হয়। উপায় হলো আইন, উপায় হলো শাস্তি। কিন্তু যে সমাজের পুরুষালি মন বিনোদনের মজমায় এতটাই নিমজ্জিত, সেখানে শুধু শাস্তি এই বিকার থামাতে পারবে না। শাস্তি তো হয় অপরাধের পর, অপরাধের আগেই আমাদের তো শিশুদের বাঁচানোর উপায় লাগবে।
মাছির মৃত্যু হয় রসাতলে। মধুর রসে পাখনা ভারী হয়ে তাতেই ডুবে সে মরে। আমাদের একদল রসাতলে ডুবছি, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের শিশুদের-নারীদের-দুর্বলদের। আনন্দ-বিনোদনের সঙ্গে অন্যায়, চুরি, নৃশংসতা যে মাত্রায় মিশে গেছে, তা থামাতে হবে, কমাতে হবে। কীভাবে? সামাজিক জাগরণ চাই, পরিবারে পরিবারে সচেতন মা-বাবা, ভাইবোন চাই, শিক্ষক চাই সব স্কুলে, সাংবাদিক ও নেতা চাই সব দলে। এই বিপদ অন্য কারও নয়, আমাদের। আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ছে রসলোভী দস্যু, আমাদের নিজ নিজ মনও ভোগদস্যুতার উপযোগী হয়ে উঠছে। হাত দিতে হবে তাই গোড়ায়।
শিশুদের একটি গল্প: এক সাদা হাতি ছোট্ট লাল একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য বনের পশুদের সঙ্গে লড়াই করে। ফুলটিকে শুঁড়ের মধ্যে আগলে রেখে সে ছোটে। বাকি সব প্রাণী ওই ফুলটি পুড়িয়ে সুবাস বানাতে চায়। কিন্তু হাতিটি তাদের বোঝায়, এটা নিছক ফুল নয়, এর ভেতরে রয়েছে আস্ত একটা জগৎ। সেই জগতে আছে অজস্র প্রাণীর এক সুখী পৃথিবী। তারাও ছেলে-মেয়ে-পরিবার আর আশা-ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে চায়। ফুলটি ধ্বংস করলে তার সবই ধ্বংস হবে। তখন প্রাণীরা বলে, প্রমাণ দাও যে তারা আছে।
কী প্রমাণ দেবে দরদি হাতিটি আর তার শুঁড়ে আগলে রাখা ফুল-জগতের লিলিপুটেরা? বন্দী হাতি তখন ফুলের ভেতরে খবর পাঠায়, ‘তোমরা চিত্কার করো, তোমরা শব্দ করে জানাও যে তোমরা আছ!’
ফুলের ভেতরের জগতে বিরাট আলোড়ন জাগে। সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে নেমে আসে মাঠে-রাস্তায়। একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে, ‘ও পৃথিবীর প্রাণীরা, তোমরা শুনছ? আমরা আছি!’
যাত্রাবাড়ীর ওই শিশুটির চিৎকার চাপা দিয়েছিল ওই খুনি, ওই ধর্ষক। কিন্তু আমাদের কানও কি চাপা দেওয়া? আমরা কেন শুনতে পাচ্ছিলাম না যে নির্যাতিত শিশুরা আমাদেরও ডেকেছিল। চিৎকার করে বলেছিল, ‘ও বড় মানুষেরা, আমরা বাঁচতে চেয়েছিলাম, তোমরা কি শুনতে পাওনি আমাদের চিৎকার?’
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *