বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ভারতীয় জেলেরা ইলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় জেলেদের অভিযোগ, প্রতিবছর ইলিশের ভরা মৌসুমে এবং ইলিশ ধরায় বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার সময় দেশের জলসীমার অন্তত ১১০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে অবাধে ইলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় জেলেরা।
ইলিশের প্রজনন মৌসুম সামনে রেখে ১ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন বঙ্গোপসাগর ও দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, ‘প্রোটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট’ ১৯৫০ অনুযায়ী ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম এই ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ বা বিক্রি নিষিদ্ধ। সরকারের এই আদেশ অমান্য করে ইলিশ মাছ আহরণ ও বিক্রি করলে এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ায় দক্ষিণ উপকূলের সমুদ্রগামী শত শত ট্রলার গতকাল শনিবার দুপুর থেকেই বরিশাল, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার মৎস্য বন্দরের ঘাটে নোঙর করতে শুরু করেছে। দেশীয় জেলেরা জানান, সাগর থেকে ফেরার সময় তাঁরা ভারতীয় অসংখ্য জেলে ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় ওত পেতে থাকতে দেখেছেন। তাঁদের শঙ্কা, নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অবাধে মাছ ধরবে। তাদের রোধ করতে না পারলে এই নিষেধাজ্ঞার তেমন সুফল মিলবে না।
গতকাল শনিবার দুপুরে কথা হয় বরগুনার পাথরঘাটায় ফিরে আসা ট্রলার মাঝি আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ফিরে আসার সময় বলেশ্বর আইল, ফেয়ারওয়ে বয়া ও মোংলা বয়ার পূর্ব পাশে শত শত ভারতীয় ট্রলার দেখে এসেছি। ওরা ওত পেতে আছে। ওরা আমাদের কয়েকটি ট্রলারকে ধাওয়াও করেছে। নিষেধাজ্ঞা শুরু হলে বাংলাদেশি ট্রলার সাগর থেকে উঠে গেলে মাছ ধরবে, সেই অপেক্ষায় আছে ওরা।’ সাগর থেকে ফেরা আরও দুই মাঝি একই কথা বলেন।
এফবি রুনু-১ ট্রলারের মালিক ও মাঝি বরগুনার পাথরঘাটার কালাম খাঁ বলেন, ভারতীয় জেলেরা ট্রলার নিয়ে দল বেঁধে মাছ শিকার করে। এ সময় যন্ত্রের মাধ্যমে ইলিশের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তারা সাগরে জাল ফেলে। বাংলাদেশের জেলেরা বাধা দিলে মাইকে হুমকি দেয়। বাংলাদেশি জেলেদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। বাংলাদেশের জলসীমার প্রায় ১১০ কিলোমিটার ভেতরে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার সোনারচর এলাকার দক্ষিণে একটি ভারতীয় মাছ ধরার ট্রলারকে দেখেন এফবি হামিম ট্রলারের মতি মাঝি। তিনি বলেন, গত ২৫ আগস্ট ওই এলাকায় ‘এফবি পুষ্পাঞ্জলি’ নামে ভারতীয় ট্রলারটিকে মাছ ধরতে দেখে তিনি মুঠোফোনে ছবিও তোলেন।
একই কথা জানালেন পাথরঘাটার এফবি ইয়াসমিন ট্রলারের জসিম মাঝি। তিনি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার সোনারচর এলাকায় মাছ ধরার সময় ভারতীয় এফবি মা বাসন্তী নামে একটি ট্রলারকে ইলিশ ধরতে দেখে মুঠোফোনে তার ভিডিও ধারণ করেন। ধারণ করা সেই ভিডিওতে দেখা যায়, ‘এমএ বাসন্তী’ নামের ট্রলারটি সাগরে মাছ ধরছে। ট্রলারটিতে ভারতীয় পতাকা উড়ছে। তার পাশ দিয়ে বাংলাদেশি অনেক ট্রলার যাওয়া-আসা করছে। বাংলাদেশি একটি ট্রলার ওই ট্রলারটির কাছে গিয়ে ভারতীয় জেলেদের কাছ থেকে পাতার বিড়ির বদলে সিগারেট বিনিময় করছে। ভারতীয় ওই ট্রলারের মেঝেতে অসংখ্য জাটকা স্তূপাকারে রাখা আছে। ভিডিওটি ওই জেলে চলতি বছরের আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে ধারণ করেছেন বলে জানান।
পাথরঘাটায় বাংলাদেশ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন জমাদ্দার বলেন, ‘ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। আমাদের জেলেরা এর প্রতিবাদ করলে ভারতের জেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে আমাদের জেলেদের মারধর ও নির্যাতন করে। ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই এর প্রতিবাদে পাথরঘাটায় বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন মৎস্যজীবীরা। পরে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপি দেওয়ার দুই বছর পরও বাংলাদেশের জলসীমায় অবাধে ঢুকে মাছ শিকার বন্ধ হয়নি। বরং চলতি বছর ইলিশের ভরা মৌসুমে ভারতীয় জেলেদের বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের প্রবণতা আরও বেড়েছে।’
জানতে চাইলে কোস্টগার্ডের দক্ষিণাঞ্চলের (মোংলা) অভিযানিক কমান্ডার লে. হায়াত ইবনে সিদ্দিকী গতকাল দুপুরে বলেন, ‘এখানে ছয় মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছি। এই সময়ে অন্তত ১৫টি ভারতীয় ট্রলার দেখেছি। আমরা তাদের প্রতিরোধ করেছি এবং আমাদের প্রতিরোধের কারণে তারা ফিরে গেছে। এ বিষয়ে আমরা সব সময় সতর্ক আছি। তবে গভীর বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করে। সেখানে বেশি ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। আমরা নৌবাহিনীকে এসব তথ্য জানাব, যাতে ভারতীয় জেলেরা কোনোক্রমেই আমাদের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যেতে না পারে। এ ছাড়া ভারতীয় কোস্টগার্ডের সঙ্গে আমরা প্রতিবছর যৌথ বৈঠক করছি। এতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।’