২৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা। রুকনুজ্জামান উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে বের হন পার্কে যাবেন বলে। পার্কে ঢোকার মুখেই একটি কালো মাইক্রোবাস চোখে পড়ে তাঁর। গাড়িটির কাচও ছিল কালো। প্যান্ট-শার্ট পরা দুই যুবক তাঁকে খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র কি না। ‘হ্যাঁ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ওই মাইক্রোবাসে তুলে ফেলেন। গাড়ির ভেতরে ছিলেন আরও পাঁচজন।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র রুকনুজ্জামান গতকাল শনিবার মুঠোফোনে এ কথা বলেন।
রুকনুজ্জামান বলেন, অপহরণকারীরা গাড়িতে উঠিয়েই তাঁর চোখ বেঁধে ফেলেন। তারপর জোর করে কিছু একটা খাইয়ে দেন। এরপর যতবারই তাঁর ঘুম ভেঙেছে, ততবারই তাঁকে চেতনানাশক ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে বলে ধারণা করছেন তিনি। তুলে নেওয়ার দুদিন পর ২৭ সেপ্টেম্বর তাঁকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালীঘাট ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে ফেলে রেখে যান অপহরণকারীরা।
কারা, কেন অপহরণ করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রুকনুজ্জামান বলেন, সরিষাবাড়ীতে ২৬ বছর আওয়ামী লীগ থেকে কেউ নির্বাচিত হননি। তিনিই প্রথম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন। এলাকায় ভালো কাজ করতে গিয়ে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বাধা পাচ্ছিলেন। এলাকায় তাঁর শত্রুও বেড়ে গিয়েছিল। প্রকাশ্যে ও মুঠোফোনে তাঁকে বারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।
রুকনুজ্জামান বলেন, অপহরণকারীদের তিনি চিনতে পারেননি। তবে কে কী করেছে, সে সম্পর্কে তিনি জানেন। ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই তাঁকে জড়িয়ে এখন মিথ্যা ও বানোয়াট খবর ছড়ানো হচ্ছে। রুকনুজ্জামান বর্তমানে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সবকিছু প্রকাশ করবেন বলে জানান।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, রুকনুজ্জামান নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় আসেন। প্রথমে একটি বায়িং হাউসে চাকরি নেন, পরে ড্রেসম্যান নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন। তিনি বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। সুবিধা করতে না পেরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং মেয়র নির্বাচিত হন। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, মেয়রকে অপহরণের সঙ্গে দলীয় কোন্দলের যোগসূত্র থাকতে পারে।
অপর একটি সূত্র বলছে, এলাকার উন্নয়নকাজ দেওয়া নিয়ে ঝামেলায় পড়েছিলেন মেয়র রুকনুজ্জামান। সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল। অপহরণের কিছুদিন আগে একজন ঠিকাদার তাঁকে হারুন অর রশিদের সামনেই লাঞ্ছিত করেন।
মেয়রের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র দাবি করে, পৌরসভার উন্নয়নকাজের জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়ার খবর শুনে হারুন অর রশিদ সব কাজ তাঁকে দেওয়ার দাবি করেছিলেন।
রুকনুজ্জামান গতকাল বলেন, গত আগস্ট থেকে ফেসবুকে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে হারুন অর রশিদের ছোট ভাই মাসুদুর রহমান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন অর রশিদ গতকাল রাতে বলেন, তাঁর পরিবারের কেউ কখনোই কোনো অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সব দলেই অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকে। সেই সুযোগ নিয়ে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
হারুন অর রশিদ বলেন, তিনি পৌরসভা নির্বাচনের সময় মেয়র রুকনুজ্জামানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ছিলেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। পত্রপত্রিকায় রুকনুজ্জামানের পারিবারিক ঝামেলা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে। মেয়র সুস্থ হলে পুলিশি তদন্ত হবে। তখন সবই বেরিয়ে আসবে।
এই হারুন অর রশিদ ঢাকার তেজগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উপাধ্যক্ষও। এর আগে উপাধ্যক্ষ ছিলেন আবদুল হান্নান। তাঁর বাড়িও সরিষাবাড়ী। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। আদালতের নির্দেশে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে হান্নানের স্থলে হারুন অর রশিদ উপাধ্যক্ষ হন। আর এই কলেজের অধ্যক্ষ হলেন হারুন অর রশিদের ভাই আবদুর রশিদ। আবদুর রশিদ আবার তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
আবদুল হান্নান ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। হান্নানের গুম হওয়া ও রুকনুজ্জামানের অপহরণের মধ্যে যোগসূত্র আছে কি না, তা নিয়ে এলাকায় আলোচনা আছে।