নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড বহনে এবং ২ হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে ইরান। ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে জাতিসংঘে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিস্ফোরক সব মন্তব্যের তিন দিনের মাথায় এ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাল দেশটি।
এ বছর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য নিয়ে আগে থেকেই বেশ ঔৎসুক্য ছিল। এর কারণ ব্যক্তিটি ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এটিই ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম জাতিসংঘ ভাষণ। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বিদ্যমান উত্তেজনা, মার্কিন নির্বাচনে রুশ সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিতর্কসহ আরও বেশ কয়েকটি কারণও ছিল এর পেছনে। আবারও বিস্ফোরক কোনো বক্তব্য দেবেন এমন ধারণা নিয়েই অপেক্ষায় ছিল বিশ্ববাসী। আর বরাবরের মতোই ট্রাম্পও তাদের হতাশ করেননি।
এ বছরের জাতিসংঘ অধিবেশন এক বিরল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছে বিশ্ববাসীকে। ট্রাম্প শুধু বিস্ফোরক মন্তব্যই করেননি; এক দেশকে ‘খুনির রাজত্ব’ এবং আরেক দেশকে পরমাণু হামলায় ‘গুঁড়িয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছেন তিনি। এমনিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে কূটনৈতিক সদাচারের আকাঙ্ক্ষা কেউ করেন না। তাঁর বক্তব্য নিয়ে এক ধরনের পূর্বানুমান ছিল। কিন্তু সব অনুমানকে ছাড়িয়ে যাওয়াই ট্রাম্পের স্বভাব। আর তা আরেকবার প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু এ প্রমাণের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প নিজের সম্পর্কিত ধারণাটিকে স্থায়ীত্ব দিলেও, অস্থিতিশীলতার আশঙ্কায় ফেলেছেন পুরো বিশ্বকেই।
ট্রাম্পের জাতিসংঘ ভাষণের পরপরই বিশ্বনেতাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পক্ষ থেকে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ট্রাম্পকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। বিপরীতে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কাছ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিস্ফোরক কোনো বক্তব্য না এলেও শুক্রবার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে তেহরান।
ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন বন্ধু দেশের নেতারাও। এর মধ্যে রয়েছেন জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘শঙ্কিত যদি নাও হয়, সবার মধ্যে অস্বস্তি কাজ করেছে। যেন বাইবেলে বর্ণিত দৈত্য গোলিয়াথ আমাদের সামনে উপস্থিত, যে অন্য দেশগুলোকে ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে।’ বন্ধু দেশগুলোর নেতাদের সবাই মুগাবের মতো সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া জানাননি। সন্দেহ নেই শঙ্কা ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার দুইই এখানে কাজ করেছে একসঙ্গে। আর এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমেরিকাকে নিশ্চিতভাবেই একঘরে করে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
জন হপকিন্স স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সংঘর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক ড্যানিয়েল সেরওয়ের এ বিষয়ে ইউএসএ টুডে বলেন, ‘এটা অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসনের মতো। উত্তর কোরিয়া, ইরান কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে যে অবস্থান নেওয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই রক্ষণশীল অবস্থান নয়। বরং এটি আক্রমণাত্মক অবস্থান।’
কঠোর প্রতিক্রিয়া এসেছে ভেনেজুয়েলা ও কিউবার দিক থেকেও। এক ইসরায়েল ছাড়া বিশ্বের সব দেশই ট্রাম্পের বক্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের বক্তব্যকে জাতিসংঘে গত ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় শোনা একমাত্র ‘সাহসী’ বক্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জাতিসংঘে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি অবশ্য ট্রাম্পের বক্তব্য ‘অনেকের’ দ্বারাই প্রশংসিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। যদিও এই অনেকের পরিচয় তিনি উত্থাপন করেননি। ফলে তাঁর এ ভাষ্যের কোনো প্রমাণ আর পাওয়া যায় না।
সিএনএন বরং নাম প্রকাশ না করেই বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছে। এর মধ্যে এক কূটনীতিক ট্রাম্পের কথিত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। আর মধ্যপ্রাচ্যের আরেক কূটনীতিক এক গাল হেসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্টেফান লোফভেন সরাসরিই বলেছেন, ‘জাতিসংঘ আলোচনার একটি সাধারণ ক্ষেত্র। এখানে কোনো দেশ অন্য দেশকে হুমকি দিতে পারে না।’
ইরান বিষয়ে শক্তিশালী অবস্থান ব্যক্ত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউর পররাষ্ট্র নীতি-বিষয়ক কমিটির প্রধান ফেদেরিকা মঘারিনি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে ইরানের সঙ্গে হওয়া চুক্তি বহাল রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এমনকি আমেরিকা এটি বাতিল করলেও ইইউ নিজের পথেই হাঁটবে বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে একই অভিমত ব্যক্ত করেছে জাপান ও জার্মানি।
অর্থাৎ উত্তর কোরিয়া, ইরান ও জলবায়ু চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থানের সঙ্গে সহমত নয় আমেরিকার দীর্ঘ দিনের বন্ধু দেশগুলো। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ট্রাম্পের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও তার আমেরিকা ফার্স্ট নীতি বহু বন্ধু দেশের মধ্যেও শঙ্কার সঞ্চার করেছে।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের অনেক আগে থেকেই পিয়ংইয়ং-ওয়াশিংটন উত্তেজনা বিরাজ করছিল। উত্তর কোরিয়া একাধিক আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। সর্বশেষ এশিয়ায় আমেরিকার কৌশলগত মিত্র জাপানের ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় দেশটি। এ ক্ষেত্রে উসকানিটি উত্তর কোরিয়ার দিক থেকে হলেও ইরানের ক্ষেত্রে কাঠগড়ায় ওয়াশিংটনই। আর ইরানের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের সময়ে করা চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়ে গত কয়েক মাসে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার নবায়ন করেন ট্রাম্প। সে সময় এক দিনের নোটিশে পরমাণু কর্মসূচি আবারও শুরুর সক্ষমতার কথা জানিয়ে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছিল তেহরান। দুই ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ অধিবেশনকে উত্তেজনা প্রশমনের একটি সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। কিন্তু তার বদলে পরমাণু শক্তি নিয়ে আরও উচ্চতর অনিশ্চয়তার সামনে এসে দাঁড়াল বিশ্ব।
জাতিসংঘ অধিবেশনের পর কিম জং উন এখন পর্যন্ত কথার লড়াই চালিয়ে গেলেও ইরান ইতিমধ্যেই তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে এর মীমাংসা না হলে এ প্রতিক্রিয়া তীব্র থেকে তীব্রতর হবে, তাতে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু বন্ধু দেশগুলোর পরামর্শ অনুযায়ী আলোচনার পথে ট্রাম্প কতটা হাঁটবেন, তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়।