সিলেটে ফের বন্যা, শতাধিক গ্রাম প্লাবিত

Slider জাতীয়


উজানের ঢলে মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সুরমা নদীর তীর উপচে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ ও ছাতকে ১৭৪ সেন্টিমিটার প্রবাহিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহরের নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে গেছে ছাতক গৌবিন্দগঞ্জ সড়ক, দোয়ারাবাজার সুনামগঞ্জ সড়ক তাহিরপুর বিশ্বম্ভরপুর সড়ক ও সাচনা সুনামগঞ্জ সড়ক।

বানের পানিতে প্লাবিত হয়েছে সদর উপজেলার সুরমা জাহাঙ্গীরনগর ও গৌরারং, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ও দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়ন, তাহিরপুরের বালিজুড়ি ইউনিয়ন, ছাতকের ইসলামপুর, নোয়ারাই, কালারুকা, গোবিন্দগঞ্জ এবং দোয়ারাবাজার উপজেলার বোগলা, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীপুর, নরসিংপুর, সদর, সুরমা ইউনিয়ন। এছাড়া চার উপজেলার ১৯টি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ছাতকের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে দুই শতাধিক পরিবার দোয়ারাবাজারের আশ্রয় কেন্দ্রে।

সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া, বড়পাড়া, সাহেববাড়ির ঘাট, ষোলঘর, নবীনগর, উকিলপাড়া, কাজীরপয়েন্ট, কালীপুর, ওয়েজখালী, মল্লিকপুর, শান্তিবাগ, কেজাউড়া, জলিলপুরসহ ৯টি ওয়ার্ডের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

এদিকে ছাতকে ফের বন্যায় নিম্নাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে ফের বন্যায় তলিয়ে গেছে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। বর্তমানে সুরমাসহ পাহাড়ি জেলা ও পিয়াইন নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার উপর দিয়ে। ছাতক-সিলেট ও ছাতক-সুনামগঞ্জ সড়কের বিভিন্ন অংশে প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতায় বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ছাতকের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন অংশে সড়কের উপর দিয়ে চলাচল করছে নৌকা। শাক-সবজির বাগান, বীজতলাসহ গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। বাড়ির আঙ্গিনাসহ নিম্নাঞ্চলে বাস করা মানুষের বসত ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, পানিবন্দি মানুষের জন্য ৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৫ শতাধিক বন্যা কবলিত পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যানুযায়ী বর্তমানে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬০ সেন্টিমিটার, চেলা নদীর পানি বিপদসীমার ১৭৫ সেন্টিমিটার ও পিয়াইন নদীর পানি ১৮৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ডাইকি, বটেরখাল ও বোকা নদীর পানিও বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমাসহ এসব নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শহরের ট্রাফিক পয়েন্ট ছাড়া গোটা শহরের রাস্তা-ঘাট ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। শহরের রাস্তায় এখন নৌকা চলাচল করছে। শহরের ফকিরটিলা-মাছিমপুর বাজার সড়ক, ইসলামপুর ইউনিয়নের ছনবাড়ি-রতনপুর সড়ক, ছনবাড়ি-গাংপাড়-নোয়াকোট সড়ক, কালারুকা ইউনিয়নরে মুক্তিরগাঁও সড়ক, বঙ্গবন্ধু সড়ক, আমেরতল-ধারন সড়ক, পালপুর-খুরমা সড়ক, বোকারভাঙ্গা-সিরাজগঞ্জ সড়কসহ উপজেলার অনেক সড়কের বিভিন্ন অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। জামুরা, চানপুর, নোয়াগাঁও, ভাসখলা, করচা, গোয়ালগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বৈশাকান্দি এফআইভিডিবি স্কুল, নোয়ারাই ইউনিয়নের চরভাড়া মাদ্রাসা, লামাপাড়া ব্র্যাক স্কুলসহ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে।

ইসলামপুর ইউনিয়নের রতনপুর, নিজগাঁও, গাংপাড়, নোয়াকোট, বৈশাকান্দি, বাহাদুরপুর, ছৈদাবাদ, রহমতপুর, দারোগাখালী, পৌরসভার হাসপাতাল রোড, শাহজালাল আবাসিক এলাকা, কানাখালী রোড, শ্যামপাড়া, মোগলপাড়া, তাতিকোনা, বৌলা, লেবারপাড়া, নোয়ারাই ইউনিয়নের বারকাহন, বাতিরকান্দি, চরভাড়া, কাড়–লগাঁও, লক্ষীভাউর, চানপুর, মানিকপুর, গোদাবাড়ী, কচুদাইড়, রংপুর, ছাতক সদর ইউনিয়নের বড়বাড়ী, আন্ধারীগাঁও, মাছুখালী, তিররাই, মুক্তিরগাও, উত্তর খুরমা ইউনিয়নের আমেরতল, ঘাটপার, গদারমহল, রুক্কা, ছোটবিহাই, এলঙ্গি, রসুলপুর, শৌলা, চুনারুচর, চরচৌলাই, হাসারুচর, প্রথমাচর, সিদ্ধারচর, চরভাড়ুকা, দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের হরিশ্বরণ, হাতধনালী, রাউতপুর, ধনপুর, চৌকা, রামচন্দ্রপুর, হলদিউরা, কালারুকা ইউনিয়নের রামপুর, মালিপুর, দিঘলবন, আরতানপুর, রংপুর, মুক্তিরগাও, ভাতগাঁও ইউনিয়নের জালিয়া, ঘাঘলাজুর, হায়দরপুর, বাদে ঝিগলী, সিংচাপইড় ইউনিয়নের গহরপুর, মহদী, গোবিন্দগঞ্জ পুরান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানান, বন্যার্তদের জন্য শহরের বৌলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তাতিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মন্ডলীভোগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছাতক সরকারি বহুমুখী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ও এসপিপিএম উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছ। ইতোমধ্যেই এসব আশ্রয় কেন্দ্র ৫ শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম চলছে।

এদিকে দোয়ারাবাজার উপজেলায় ফের দ্বিতীয় দফায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পানি অব্যাহত থাকায় উপজেলার সবকয়টি নদনদী ও হাওরের পানি বিপদজনক ভাবে বাড়তে শুরু করেছে। লোকালয়ে প্রবেশ করেছে বন্যার পানি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় ইতোমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এতোদিন বাড়ির আশপাশে পানি থাকলেও এখন আবার নতুন করে বাড়িঘরের ভেতরে পানি প্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়ক, দোয়ারাবাজার-বাংলাবাজার সড়ক, দোয়ারাবাজার লক্ষীপুর সড়ক, নরসিংপুর-শ্যামারগাঁও, কাঞ্চনপুর-দোহালিয়া সড়কের বিভিন্ন অংশে পানি বাড়তে থাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব রোডের যাত্রীরা। উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন হাটবাজারে উঠতে শুরু করেছে বন্যার পানি।

এদিকে আবারও হুমকির মুখে পড়েছেন মাছ চাষীরা। বন্যার পানি বিভিন্ন মাছের খামারে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পানির স্রোতে অনেকের পুকুরের পাড় ভেঙ্গে মাছ ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পুকুরের সুরক্ষায় বৃষ্টির মধ্যেই রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন মাছ চাষীরা।

উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অনুকূল চন্দ্র দাস জানান, পুনরায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে পানি প্রবেশ করেছে। এ অবস্থায় সকল প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ এবং সার্বক্ষণিক বিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উপজেলার বন্যা কবলিত ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।

দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা প্রিয়াংকা জানান, বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় বন্যার পানি বাড়তে শুরু করেছে। উপজেলার সবকটি নদনদীর পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত এলাকায় গিয়ে আমরা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করেছি। নতুন করে আরো ২০ মেট্রিক টন জিআর চাল বিতরণ করেছি। ত্রাণ কার্যক্রম চলমান থাকবে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহরুল ইসলাম বলেন, গেল ২৪ ঘণ্টায় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৮১২ মিলিমিটার ও সুনামগঞ্জে ৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবার ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত সুনামগঞ্জে উজানের ঢলে পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো শফিকুল ইসলাম জানান, দুর্গত এলাকায় চাল শুকনা খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলার সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে প্রশাসনের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *