সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাতে কোন রোহিঙ্গা ভারতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর ‘অরক্ষিত’ এলাকাগুলোকে চিহ্নিতকরণের জন্য বিএসএফ’কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দিল্লি থেকে।
তবে শুধু বিএসএফ’ই নয়, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দেশের সব কেন্দ্রীয় নিরপত্তা এজেন্সি এবং রাজ্যের নিরাপত্তা এজেন্সিগুলিকে নির্দেশিকা পাঠিয়ে মসজিদ, অনিবন্ধিত মাদ্রাসা, সীমান্তবর্তী স্টেশন, বাস টার্মিনাসগুলিতে কড়া নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আসলে রোহিঙ্গ ইস্যুতে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মতভেদ তৈরি হলেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপই নিয়েছে দেশটির কেন্দ্র সরকার।
এ ব্যাপারে বিএসএফ’এর আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) পি এস আঞ্জানেউলু জানান, ‘দক্ষিণ বঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ভারতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে যে নির্দেশ এসে পৌঁছেছে তা খুবই পরিষ্কার। এই বিষয়টিকে কঠোর হাতে মোকাবিলা করা হবে। এই সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করে দেওয়া। বিষয়টি নিয়ে আমরা সব নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর সঙ্গে সমন্বয়কারী বৈঠক করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অরক্ষিত বর্ডার আউটপোস্টগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। ’
বিষয়টি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই দিল্লিতে বিএসএফ’এর শীর্ষ কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক সেরেছেন। গত মঙ্গলবারও কলকাতায় বিএসএফ’এর দক্ষিণবঙ্গ হেডকোয়ার্টরে বৈঠকে বসেন বাহিনীর কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের বিষয়টি পরিষ্কার হয়, তা হল আগে সন্দেহভাজন রোহিঙ্গাদের আটক করে তাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হতো। কিন্তু তাদের এখন পুশ ব্যাক করা হবে।
যদিও এই কাজটা তুলনামূলকভাবে একটু কঠিন বলেও মনে করছে বিএসএফ’এর কর্মকর্তারা। রোহিঙ্গাদের চিহ্নিতকরণের জন্য স্থানীয় মানুষদের সাহায্য নেওয়ার পাশাপাশি কাস্টমস, অভিবাসনসহ অন্য এজেন্সিগুলির সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াচ্ছে।
বিএসএফ’এর এই কর্মকর্তা জানান, ‘রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করাটা একটু কঠিন কাজ। কারণ তাদের কাছে খুব বেশি ডকুমেন্টস বা নথি থাকে না। আসলে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে তারপর তারা ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করে।
রোহিঙ্গারা মূলত যে রুটগুলি দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করে সেগুলিকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরচব্বিশ পরগনা জেলার ঘোজাডাঙ্গা এবং পেট্রাপোল সীমান্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রবেশের পরই রোহিঙ্গাদের কলকাতায় পৌঁছোনোর সম্ভবনা রয়েছে। এরপর সেখান থেকে তারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বেশ কিছু জায়গায় এখনও অরক্ষিত, অনেক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যেই গ্রামগুলি অবস্থিত সেক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারী বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করাটা একটু কঠিন’। যদিও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরতে স্থানীয় সোর্স কাজে লাগানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বিএসএফ’এর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ১৭৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। ৩৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এই অঞ্চল দিয়ে ভারতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয় ২০১৩ সালে। ওই বছরে ১০৮ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে বিএসএফ। ২০১৪ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা অনেকটাই কমে, সে বছর মাত্র ১২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়, ২০১৫ সালে আটক করা হয় ২২ জন রোহিঙ্গাকে, ২০১৬ সালে ২৬ জন্য ২০১৭ সালে এখনও পর্যন্ত ৭ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গারা জাতীয় নিরপত্তার ক্ষেত্রে তারা হুমকির কারণ বলে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। গত সোমবারই সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সেকথা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে লস্কর ও জেএমবি-এর মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলির যোগসাজেশ রয়েছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কেন্দ্র।
যদিও কেন্দ্রের এই অবস্থানের বিরোধিতা করে রোহিঙ্গাদের পাশেই দাঁড়ান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তাঁর অভিমত, ‘সব রোহিঙ্গারাই সন্ত্রাসবাদী নয়’। এমনকি রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে যে আবেদন রেখেছিল তাকেও সমর্থন করেন মমতা।
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শিশু অধিকার কমিশন। শীর্ষ আদালতে হলফনামা জমা দিয়ে কমিশন জানায় রোহিঙ্গা শিশু ও নাবালক-নাবালিকাদের জোর করে ফেরত পাঠানো অর্থ তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা।