বৃষ্টি-কাদার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নতুন যুদ্ধ

Slider সারাবিশ্ব

 

উখিয়া থেকে টেকনাফ। মানুষ আর মানুষ। ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত রোহিঙ্গা। ত্রাণের গাড়ি ঢুকলেই ছুটছে পাগলের মতো। শত শত অনাহারী হাত একসঙ্গে বাড়িয়ে দিচ্ছে সামনে। এ অবস্থায় গাড়ি থেকে ছুড়ে মারা হচ্ছে কাপড়-চোপড়। কিংবা ত্রাণের প্যাকেট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাপড় গায়ে না লাগায় নিচ্ছেন না রোহিঙ্গারা। ফেলে দিচ্ছেন অনেকেই। আরাকান সড়কের দু’পাশে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে স্তূপ স্তূপ ত্রাণের পোশাক।
এরই মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে বৃষ্টি। সোমবার রাত থেকে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তাতে কাদায় মাখামাখি তাদের ছোট্ট তাঁবুর মেঝে। বৃষ্টি-কাদায় রাতদিন যুদ্ধ চলছে তাদের। এতে বসে বা শুয়ে বিশ্রামের সুযোগটিও হারিয়েছে অনেকেই। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে-বসে থেকে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা। আরাকান সড়কের পাশে বাঘঘোনার অনিবন্ধিত অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্প। পিচ ঢাকা রাস্তার পূর্বপাশের সমতল হয়ে পাহাড়ের ঢালে মিশে গেছে শতাধিক তাঁবু। উপরে পলিথিন। নিচের মাটিতে কাপড় বা মাদুর পাতা। এতটুকুন তাঁবুর নিচে মাথা গুজেছে নিকটাত্মীয়ের তিন পরিবার। এই তিন পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৬। এর মধ্যে রয়েছেন আবু ছৈয়দ, তার স্ত্রী ও ৭ মেয়ে। মেয়েদের বয়স ১ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। সঙ্গে তার শ্বশুর আবদুস সালামের পরিবারের ৪ জন। আর স্ত্রীর ভাই মো. আমিন ও তার স্ত্রী। এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে ঢুকে সেই পাহাড়ের ঢালের কিছু অংশের মাটি সমান করে উপরে পলিথিন টানান তারা। প্রথম তিন দিন সেখানে মাদুর পেতে কোনোমতে গাদাগাদি করে শুয়ে-বসে কাটান। ঘুমিয়েছেন পালা করে। এরপর বৃষ্টিতে তাদের সেই ঘরের মেঝে কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। এরপর গত সোমবার রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মধ্যে। এতে তার ঘরের মেঝে একেবারে কাদায় মাখামাখি। ডুবে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি। বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ালেই পা ঢুকে যাচ্ছে কাদায়। এতে তাদের ঘুম হারাম। কাদার সঙ্গে যুদ্ধ করেও বসার উপযোগী করতে পারেনি সেই ঘরের তলা। রক্ষা হচ্ছে না চারদিকে নালা কেটেও। বৃষ্টির পানি ও সেই পানিতে পাহাড় চুইয়ে ভিজছে। ভিজা মাটিতে হাঁটাহাঁটিতে কেবলই বাড়ছে মেঝের কাদা। অবশেষে সেই আশ্রয়ে টিকতে না পেরে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে বসে সময় পার করছে ওই চৌদ্দজনের ৩ পরিবার।
শুধু উখিয়ার বাঘঘোনা নয়। উখিয়া-টেকনাফের অন্তত অর্ধডজন স্থানে শরণার্থীদের তাঁবু বৃষ্টি ও কাদায় মাখামাখি হতে দেখা গেছে। কেউ কাদার উপর চট বিছিয়ে থাকলেও অনেকের সেই সুযোগও হচ্ছে না। উখিয়ার বালুখালীতে রাস্তার দু’পাশে টানানো তাঁবুগুলোর অধিকাংশের মেঝে কাদায় মাখামাখি করতে দেখা গেছে। একই পরিস্থিতি দেখা গেছে টেকনাফের উনচিপ্রাং, উলুবুনিয়া, কানজরপাড়া এলাকা ও নয়াপাড়া ক্যাম্পের আশপাশেও।
বাঘঘোনার ভুক্তভোগী আবু ছৈয়দ মানবজমিনকে বলেন, আমরা বাংলাদেশে আসার পর রাস্তার পাশের এই পাহাড়টি খালি দেখে সাফ করে তাঁবু টানিয়েছি। প্রথম তিনরাত বৃষ্টি না হওয়ায় মশা ও পোকামাকড়ের কামড় সহ্য করেও বিশ্রামটুকু নিতে পেরেছি। কিন্তু বৃষ্টির পর থেকে পাহাড় চুইয়ে তাঁবুর মেঝেতে কাদা জমে গেছে। বৃষ্টির পর কাদা পরিষ্কার করেছি। কিন্তু পরের বৃষ্টিতে আবার তা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। গত দু’রাত ধরে আর অবস্থানও করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে-বসে থেকে নির্ঘুম রাত কাটছে।
গতকাল বুধবার। বেলা ১টা। টেকনাফের উনচিপ্রাং। রাস্তার দু’পাশে বসে আছে শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ। একটি মাইক্রোবাস কাছে আসতেই গতি কমে আসে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির পেছনে ছুটতে শুরু করে নানা বয়সী মানুষ। আর গাড়ি থেকে রাস্তার দু’দিকে যাত্রীরা তাদের লক্ষ্য করে ছুড়ে মারতে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পোশাক। গাড়ির কাছে মানুষের ভিড় বাড়তেই গতি বাড়ে গাড়িটিরও। গাড়িটি কিছুটা দূরে চলে গেলে থামে পেছনের রোহিঙ্গারা। কেউ কাপড় পেয়েছে তো কেউ পায়নি। এরপর সেই কাপড় পছন্দের পালা। গায়ে মাপ দিয়ে দেখে অনেকেই। কিন্তু ছেলে পেয়েছেন মেয়ের পোশাক। আর মেয়েরা পেয়েছে ছেলের পোশাক। বৃদ্ধের হাতে পড়েছে শিশুর পোশাক। ফলে তাদের বেশির ভাগ লোকই নেড়েচেড়ে দেখে তা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেয়। কাপড়ের চাহিদা সত্ত্বেও কোনো কাজে আসেনি সেই ত্রাণের অধিকাংশ পোশাক। সেই সঙ্গে তাদের ত্রাণের পোশাকের জন্য সেই দলে ভিড়ে কিছু স্থানীয় এবং পুরনো রোহিঙ্গাও। শুধু এই বার নয়। এভাবে গত তিন সপ্তাহ ধরে চাহিদা ও পরিমাপ নিরুপণ না করে গাড়ি থেকে ত্রাণের পোশাক বিতরণ করা হয়েছে। বহু ট্রাক-মিনি ট্রাক থেকেও  ছুড়ে ফেলা হয়েছে এভাবে একের পর এক ত্রাণের পোশাক। সেই পোশাক কাজে না আসায় কাড়াকাড়ি করে নেয়ার পর পরই অনেকেই তা ফেলে দিয়েছে। এভাবে দিনের পর দিন ধরে আরাকান সড়কের দু’পাশে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় পোশাকের স্তূপ জমে আছে। বৃষ্টি আর কাদায় মিশে যাচ্ছে।
উনচিপ্রাংয়ে কাড়াকাড়ি করে পোশাক হাতে পাওয়ার পর ফেলে দিয়েছেন কেন জানতে চাইলে মংডু থেকে আসা মধ্যবয়সী শাকেরা বলেন, আমার হাতে একটি কালো শার্ট এসে পড়ে। মনে করেছিলাম তা বোরকা। অন্য এক নারী পোশাকের এক অংশ ধরে টানাটানি শুরু করে। তাই কাড়াকাড়ি হয়েছে। পরে দেখি তা বোরকা নয়। শার্ট। তাই ফেলে দিয়েছি। একইভাবে প্রতিযোগিতা করে পাওয়া পোশাক ফেলে দিয়েছেন হাসিনা, লালু, করিমদাদ ও শাহেদ।
এদিকে ত্রাণের খাবার বিতরণেও চলছে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা। ফলে প্রতিদিন অনেকে একাধিকবার ত্রাণ পেলেও অনাহারী থাকতে হচ্ছে অনেক রোহিঙ্গাকে। কুতুপালং ক্যাম্পের পশ্চিমপাশে একটি পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ১৭০টি পরিবার। তাদের অবস্থান বেশ কিছুটা দূরে হওয়ায় একবারও ত্রাণ পাননি বলে জানান তারা। তাদেরই একজন চান মিয়া।
তিনি বলেন, রাস্তার পাশে থাকা অনেকে একাধিকবার ত্রাণ পেলেও আমরা কয়েকদিন ধরে কোনো ত্রাণ পাচ্ছি না। তাই ত্রাণ না পাওয়া সব পরিবারের তালিকা করে বাইরে এসে ত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *