মিয়ানমারে নিরাপত্তা অঞ্চলের প্রস্তাব

Slider সারাবিশ্ব

34b91daffa4882f1c1491a6c9da43b02-59b1adc3be2b5

মিয়ানমারের ভেতরে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে নির্যাতিত না হয়, সে জন্য সেখানে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ তৈরির ব্যাপারে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক মহলকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস (আইসিআরসি), জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ান, ইসলামি দেশগুলোর সংস্থাসহ (ওআইসি) জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কাছে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আজ শুক্রবার টেকনাফের কুতুপালং ও উখিয়ার বালুখালীতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া যায় কি না, তা সরেজমিনে পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত নেবেন।

পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় সংস্থা ও সংগঠনগুলোকে পাঠানো চিঠিতে তাঁরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের ভেতরে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ করা হোক, যাতে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত না হয়। একই সঙ্গে যারা পালিয়ে আছে, তাদের কূটনৈতিক চ্যানেলে ফেরত নিতে যা যা করা দরকার, তা করার অনুরোধ করা হয়েছে। সরকার মনে করে, রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতেই হবে, এরা মিয়ানমারের নাগরিক। এর কোনো বিকল্প নেই।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবাধিকার দলিল অনুযায়ী জীবনের প্রতি হুমকি থাকে এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। আর সরকার যেভাবে চাইছে, সেভাবে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। সরকারের দাবির সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির মিল নেই। এই অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হলে শুধু চিঠি চালাচালিতে চলবে না, বাংলাদেশকে আরও অনেক শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের কয়েকটি তল্লাশিচৌকিতে উগ্রবাদীদের হামলার সূত্র ধরে রাখাইন রাজ্যে দমন অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এরপর থেকেই প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। গত বুধবার পর্যন্ত কয়েক দিনে প্রায় পৌনে ২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। পালিয়ে আসা আশ্রয়প্রার্থীরা সীমান্তের ওপারে সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পরিকল্পিত দমন অভিযানের বিবরণ দিয়েছেন।

এর আগেও গত বছরের অক্টোবরে একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেবার ৮৪ হাজার আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এ ছাড়া কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে দমন-পীড়নের হাত থেকে বাঁচতে আরও ৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে।

পররাষ্ট্রসচিব মো. শহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই রোহিঙ্গারা সকলে ফেরত যাক। এ ক্ষেত্রে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হোক। ওই প্রতিবেদনে স্পষ্টই বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনা এবং তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হবে।’ সচিব বলেন, ‘শুধু আন্তর্জাতিক সংস্থা নয়, আমরা প্রতিটি মিশনে (দূতাবাসে) চিঠি দিয়েছি। সবাইকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি।’

তবে রোহিঙ্গা-সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে বাংলাদেশ যা করছে, তা যথেষ্ট কি না, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী সরকার রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত দিতে পারে না। আর এই সমস্যাটা আজকের নয়, অনেক দিনের। কিন্তু গত ১০-১৫ বছরে কোনো ফোরামে বাংলাদেশ বিষয়টি উত্থাপন করেনি। অন্যদিকে মিয়ামনার যেখানে গণহত্যা চালাচ্ছে, সেই দেশে আমরা চাল কিনতে যাচ্ছি, এটা কি নৈতিক হলো? এতে সরকারের অবস্থা কী বোঝায়?’

এদিকে রোহিঙ্গারা যাতে কোনোভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে ভূমি মাইন পেতে রাখা সংক্রান্ত খবরে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দিন গতকাল এসব বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত তৎপর আছি। আমরা ইতিমধ্যে আসিয়ান জোট, ওআইসি, জাতিসংঘকে চিঠি দিয়ে মিয়ানমারের নাগরিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। এ ছাড়া তাদের “পুশব্যাক” করতে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি।’

নতুন আসা রোহিঙ্গাদের কোনো হিসাব না থাকায় জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাহিনীকে পরিচয় ও তালিকা রাখার জন্য বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস প্রতিষ্ঠা, দুই দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে চুক্তি, সীমান্তে যৌথ টহল এবং সর্বশেষ গত সপ্তাহে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা প্রবেশ বন্ধে সীমান্ত এলাকায় রাস্তায় যান চলাচল সীমিত করা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব শাহ্ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গিয়ে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখব। ওখানে কে কীভাবে আছে, তা তো আমরা জানি না। কেউ সমতল ভূমিতে আছে, কেউ লুকিয়ে আছে। সব সরেজমিনে দেখে সিদ্ধান্ত নেব। খাওয়া, থাকা, স্যানিটেশনসহ সব ব্যবস্থাই আমরা সাময়িকভাবে করব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *