সীমান্তে আটকা লাখো রোহিঙ্গা মানবিক বিপর্যয়

Slider সারাবিশ্ব

81643_f1

 

 

 

 

 

 

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত। উভয় দেশভুক্ত গ্রাম তুম্বরু। তুম্বরু দু’ভাগ হয়ে বসেছে সীমান্ত পিলার ও কাঁটাতারের বেড়া। তা পেরিয়ে নো-ম্যানস ল্যান্ড বা জিরো পয়েন্টের বাংলাদেশ অংশে ঢুকে পড়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীর পাহারায় তারা সেখানেই আটকা পড়েছেন। দুই থেকে ১২ দিনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত রোহিঙ্গারা খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে চরম ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় ভুগছেন। জ্বর, ডায়েরিয়াসহ নানা অসুখে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। রয়েছে চরম দুর্ভোগে। খাদ্য ও পানীয় সংকটে ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত মানুষের কান্নাকাটি, বিলাপ, কাড়াকাড়িতে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ। ছোট্ট পাহাড়ি ঝিরি তুম্বরু খালের পাড়ে দিন দিন মৃত্যুর তাড়া খাওয়ায় নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা বাড়ায় সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। ত্রাণ ও চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা না পৌঁছায় সৃষ্টি হয়েছে অরাজক ও অমানবিক পরিস্থিতি।
গতকাল দুপুরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুম্বরু সীমান্ত এলাকায় এমন পরিস্থিতি চোখে পড়ে। বাংলাদেশ সংলগ্ন ১০ থেকে ৩০ ফুট প্রস্থের খালের তীরেই শুয়ে-বসে অনাহারে দিন কাটছে তাদের। তারা যাতে মিয়ানমারে ঢুকতে না পারে সে জন্য তুম্বরুর মিয়ানমার অংশে পাহারা বাড়ানোর সঙ্গে গত এক সপ্তাহ ধরে স্থলমাইন বসানো হচ্ছে বলে জানান একাধিক রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাংলাদেশিরা। গতকাল বিকাল ৩টা ৫৬ মিনিটে মাইন বিস্ফোরণে একটি কুকুর মারা গেছে। সকালে আরও একটি মাইন বিস্ফোরণে ১২ বছরের এক রোহিঙ্গা শিশু গুরুতর আহত হয়েছে। গত সোমবার দুপুরে মাইন বিস্ফোরণে এক নারীর দু’পা উড়ে গেছে।
তুম্বরু খালের তীরে নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান নেয়া মিয়ানমার-তুম্বরুর বাসিন্দা নূর হোসাইন বলেন, মঙ্গলবার তুম্বরুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুলি চালিয়েছে। বহু ঘরে আগুন দিয়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে রাইমংখালীও। আমরা যাতে ওই পারে ঢুকতে না পারি সেজন্য কয়েকদিন ধরে তারা সীমান্তে মাইন বসাচ্ছে। কয়েকটি মাইন খালী চোখে দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে এখানে দু’দিনে চারটি মাইন বিস্ফোরণ হয়েছে।
একই সঙ্গে গত ৫ দিন ধরে আটকেপড়া একই এলাকার বাসিন্দা মুজিব উল্লাহ বলেন, শুধু এখানেই অন্তত ২০ হাজার মানুষ আটকা পড়েছে। এছাড়া কুমিরখালী, শিলখালী, সাতকানিয়াপাড়া, কেয়াংচিবং, মেদি, রেমংখালী, ফকিরা বাজার, বালুখালী, সাহেববাজার, লাউয়া, পানির ছড়াসহ বিভিন্ন সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অন্তত লাখো রোহিঙ্গা আটকা পড়েছেন বলে জানান তিনি।
তুম্বরু খালের তীর ধরে নো-ম্যানস ল্যান্ডে হেঁটে দেখা গেছে, শিশুরা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে। বিলাপ করছেন নারীরা। কোটরে ঢুকে গেছে সবার চোখ। নিরুপায় পুরুষরা বসে আছেন এদিক- ওদিক। পানির জন্য নারী ও শিশুরা বাংলাদেশের এপার থেকে স্থানীয়দের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে। খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন অধিকাংশ মানুষ। ময়লা-ছেঁড়া পোশাক। অনেকের হাতে-পায়ে, গায়ে আঘাতের চিহ্ন। কারো কারো শরীরে গুলি। জ্বর-ডায়েরিয়াসহ নানা রোগে ভুগছেন তারা। অনেকে রক্তাক্ত। জীর্ণ-শীর্ণ শরীর। ক্ষুধায় কথা বলার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছেন।
মংডুর গারতি বিল থেকে পাহাড়ে পাহাড়ে ৭ দিন লুকিয়ে গত ৫ দিন আগে ওই সীমান্তে পৌঁছা জাফর আলম বলেন, আসার পথে আমার স্ত্রী ছকিনা সন্তান প্রসব করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। কোনো চিকিৎসা পাচ্ছি না। আমার আর এক শিশু সন্তানের জ্বর। তারও চিকিৎসা হচ্ছে না। শুধু চিকিৎসা নয়। আমরা জঙ্গলে দিনের পর দিন না খেয়ে এখানে উঠতে পেরেছি। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত কোনো খাবার পাইনি। পানি নেই। কেউ কিছু একটা জোগাড় করতে পারলে কাড়াকাড়ি লেগে যাচ্ছে। কেউ কেউ একটি পলিথিন জোগাড় করতে পারলেও এ অবস্থায় স্ত্রী ও শিশুসহ বৃষ্টিতে ভিজছি।
তার কথার প্রমাণ মিললো কিছুক্ষণের মধ্যেই। সেই এলাকা দিয়ে এক ব্যক্তি কিছু কলা ও মুড়ি নিয়ে সীমান্তের কাছে গেলেই ঝাঁপ দিয়ে তুম্বরু খালের পাড়ে শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। লেগে যায় কাড়াকাড়ি। বিতরণের আগেই সব শেষ। কেউ পেয়েছেন, তো কেউ পাননি।
কলসি মাথায় খালের কোমর পানি মাড়িয়ে বাংলাদেশে আসা গারতি বিলের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম বলেন, ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সহ্য করতে না পেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পানির জন্য এসেছি। ক্ষুধা ও পানির জ্বালায় মারা যাবো। আমি গত তিনদিন আগে দু’মুঠো ভাত খেয়েছিলাম। তারপর থেকে উপোস। বাচ্চারা কাঁদছে। মায়ের বুকে দুধ নেই। আমরা কোনো বাজারে যেতে পারছি না। আমরা মৃত্যুর চেয়ে বেশি কষ্টে আছি। আমরা মরে গেলে বেঁচে যেতাম। এখন মনে হচ্ছে যারা মরেছে তারা বেঁচে গেছে। অনেকের ডায়রিয়া। গতকাল এক শিশু এক নারী ডায়েরিয়াতে মারা গেছেন। এভাবে আর দু’-একদিন থাকলে ক্ষুধায়ও মারা যাবে বলে জানান তিনি।
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তে যে অমানবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার ভাষায় বোঝানোর মতো না। যারা এদেশে ঢুকছে তারা কিছু সহায়তা পেলেও জিরো পয়েন্টে আটকেপড়ারা অমানবিক সময় পার করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *