প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গার ঢল অব্যাহত আছে। পালিয়ে নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় নৌকাডুবিতে নিহত আরও ১৮ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আজ শুক্রবার সকালে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় টেকনাফ পুলিশ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী ও শাহপরীর দ্বীপে নদী থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
গতকাল বৃহস্পতিবার শাহপরীর দ্বীপে সাগর উপকূল থেকে ১৯ রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। আর মঙ্গলবার নাফ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল চার রোহিঙ্গার মৃতদেহ। এ নিয়ে গত কয়েক দিন নৌপথে আসার সময় নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাল ৪১ জন রোহিঙ্গা।
রাত থেকেই টেকনাফে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত চলে টানা কয়েক ঘণ্টার ভারী বর্ষণ। এই বর্ষণের মধ্যেই বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে শত শত রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা গত ২৪ আগস্ট থেকে পরবর্তী ছয় দিনে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের কথা জানিয়েছিল। এখন পর্যন্ত কতজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ করেছে তার তথ্য সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও প্রশাসন জানাতে পারেনি। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা অন্তত ৪০ হাজার। এর আগের আট দিনে এসেছে আরও ৪০ হাজার।
টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও রোহিঙ্গারা দলে দলে ঢুকে পড়ছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। নাফ নদীতে নৌকাডুবির সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে নাফ নদী থেকে ১৮ রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া গেছে। এগুলো মিয়ানমার থেকে ভেসে আসে বলে খবর পাওয়া গেছে।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, আজ ভোরে ইউনিয়নের উনচিপ্রাং ও লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। তাদের অনেকে ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইন উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই দিনে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের আটক করে এক সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠালে অন্য সীমান্ত দিয়ে তারা আবার ঢুকছে। সড়ক, পথঘাট, অলিগলি সবখানে এখন রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। তিনি জানান, আজ উদ্ধার করা ১৮ মৃতদেহের মধ্যে ১১ জন পুরুষ, পাঁচজন নারী ও দুটি শিশু।
পালিয়ে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গা প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের দিন রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ‘গণহত্যা’ চালানো হবে—এমন গুজবের পর রোহিঙ্গারা দলে দলে সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন।
আজ সকালে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে দেখা গেছে, অসংখ্য রোহিঙ্গা নৌকা থেকে নেমে টেকনাফ শহরের দিকে রওনা দিয়েছেন। কেউ রিকশা, আবার কেউ ইজিবাইকে উঠেছেন। সেখানে কথা হয় আমেনা খাতুন (৬০) নামের এক নারীর সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, রাখাইন রাজ্যে গত দুই দিন ধরে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে। আজ ভোরে তাঁরা রাখাইন রাজ্যের ফাদনচা গ্রাম থেকে নৌকা নিয়ে এখানে নেমেছেন। এখন টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে যাচ্ছেন। সেখানে তাঁদের আত্মীয়স্বজন আছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, গত দুই দিনে টেকনাফের নয়াপাড়া, সাবরাং, নাইটংপাড়া, জাদিমুরা, নীলা, হোয়াইক্যং, উখিয়ার বালুখালী, রহমতেরবিল, ধামনখালী, আঞ্জুমানপাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু, চাকঢালাসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছেই। এত দিন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড ও পুলিশের কড়াকড়ির কারণে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেনি। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গা স্রোত আটকানো যাচ্ছে না।
উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, রাখাইন রাজ্যে দমন-পীড়নের মুখে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি হিন্দুরাও বাংলাদেশ পালিয়ে আসছেন। উখিয়ার একটি পরিত্যক্ত মুরগির খামারে আশ্রয় নিয়েছেন রাখাইন রাজ্যের ফবিরাবাজার থেকে পালিয়ে আসা ৪১২ জন হিন্দু নারী, পুরুষ ও শিশু।
তুলাতুলী গ্রাম থেকে নদী সাঁতরে গত বুধবার রাতে কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে পৌঁছান কয়েকজন রোহিঙ্গা। তাঁদের একজন কামাল আহমদ (৪০) প্রথম আলোকে বলেন, নাফ নদীতে আগে মাছ শিকারের জন্য শত শত নৌকা থাকত। নিষেধাজ্ঞার কারণে নদীতে এখন নৌকা থাকে না। এক-দুইটা নৌকা পাওয়া গেলে তাতে গাদাগাদি করে রোহিঙ্গারা ওঠে পড়েন। ফলে একাধিক নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে।
উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির দুটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জামাল হোসেন ও আবু ছিদ্দিক বলেন, গত আট দিনে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছে প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। এর মধ্যে কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। অন্যরা টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ সেখান থেকে কক্সবাজার, বান্দরবান ও চট্টগ্রামের দিকে চলে যাচ্ছেন।
আবু ছিদ্দিক বলেন, ঈদে আরও রোহিঙ্গার ঢল নামতে পারে। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার কয়েক কিলোমিটার নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান করছেন। ঘরবাড়িহারা এসব রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ছাড়া নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।