সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নানা উদ্যোগ, বার বার স্বস্তির যাত্রার আশ্বাস, সড়ক ও রেলপথ কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে রাতদিন সংস্কার-মেরামতের কাজ চালিয়েও ‘স্বস্তিদায়ক ঈদযাত্রা’ নিশ্চিত করা যায়নি। রেল, বাস, লঞ্চের সর্বত্রই সীমাহীন ভোগান্তির মধ্য দিয়ে বাড়িমুখে পাড়ি জমিয়েছেন মানুষজন।
অগত্যা ট্রেনের ছাদে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির পথে ছুটছেন অসংখ্য মানুষ।
পরিবার ও বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে রাজধানী ছাড়ছেন লাখো মানুষ। গতকাল ভোর থেকেই যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় জমে রেলস্টেশনে। সকালের আলো ফোটার আগেই কমলাপুর স্টেশনসহ আশপাশের এলাকা লোকে-লোকারণ্য হয়ে ওঠে। রাজধানী ছাড়ার প্রতিটি স্টেশন তথা ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর, টঙ্গী তিল ধারণেরও ঠাঁই ছিল না। গন্তব্য পথের প্রতিটি ট্রেনই মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী উঠিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা ছেড়েছে।
এ ছাড়া সড়কপথের সর্বত্রই যানবাহন চলেছে ধীর গতিতে, থেমে থেমে। ফলে বাস-মিনিবাস সচল থেকেছে ঠিকই, কিন্তু গন্তব্যস্থলে কত ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে- তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেননি। এদিকে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের সে াত নেমেছে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটেও। গতকাল সকাল থেকেই সেখানে লঞ্চ, স্পিডবোট এবং ফেরিতে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। এবারও শিমুলিয়া ঘাটের পাশাপাশি পুরনো কাওড়াকান্দি লঞ্চঘাট চালু রেখে যাত্রী ভিড় সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই নৌরুটে সাধারণত ১৭টি ফেরি চললেও ঈদ উপলক্ষে আরও ৩টি ফেরি মিলিয়ে এখন ২০টি ফেরি চলছে। এ ছাড়া ৮৭টি লঞ্চ ও শতাধিক স্পিডবোট নিয়মিত কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে যাত্রী পারাপার করছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
অন্যদিকে ঘরমুখো যাত্রীবাহী যানবাহনের চাপ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় পাটুরিয়া ঘাটে তীব্র যানজট দেখা দেয়। ফেরি পারের অপেক্ষায় আটকা পড়ে যাত্রীবাহী বাস, মাইক্রোবাস, ট্রাকসহ শত শত যানবাহন। পাটুরিয়ায় ঘাট এলাকা থেকে ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়কের নবগ্রাম পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল বাস-ট্রাকের দীর্ঘ লাইন। এতে যানজটে আটকে পড়া যানবাহন চালক, হেলপার ও ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার বন্ধ রেখেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি।
দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো এবং বাড়িঘর-স্থাপনা। বন্যাকবলিত এলাকায় সড়ক, সেতু, রেললাইন, কালভার্টসহ বেহাল হয়ে পড়েছে। এবারের বন্যায় বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশের উত্তর, মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ২৭ জেলার ১৫৪টি উপজেলার প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সেসব এলাকার ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। ১০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দুই হাজার ৮০০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ভেঙে গেছে বা বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে বহু সেতু ও কালভার্ট।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা অফিস সূত্রে জানা গেছে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে চলাচলরত ১৮টি ফেরির মধ্যে ১৭টি ফেরি চলাচল করছে। ফেরিগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় নদীতে প্রবল সে াতের বিপরীতে চলতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটির মুখে পড়ছে। পাটুরিয়া ঘাটে স্থানীয় ভাসমান কারখানায় প্রতিদিন দুই-চারটি ফেরি সাময়িক মেরামতেও থাকছে। এখনো রো-রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পাটুরিয়া ঘাটে ভাসমান কারখানায় মেরামতে রয়েছে।
বাস টার্মিনাল : গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর মহাখালী-গাবতলী বাস টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা গেছে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যা আরও বেড়েছে। যাত্রীরা সময়মতো বাস না ছাড়ার অভিযোগ করেছেন। বলেছেন, নির্ধারিত সময়ের দেড়-দুই ঘণ্টা পর এসেছে বাস। তবে বাস অপারেটররা এ জন্য দুষেছেন মহাসড়কের যানজটকে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) হিসাবে, সাম্প্রতিক বন্যায় সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১৭টি সড়ক বন্যার পানির তোড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নেত্রকোনা জেলায় ৫টি সড়কে স্থানে স্থানে পানি থাকায় চলাচল প্রায় বন্ধ। জামালপুর, ফরিদপুর ও শরীয়তপুরের তিনটি সড়কের কিছু অংশ পানিতে নিমজ্জিত। এর মধ্যেই বিভিন্ন দূরপাল্লার পরিবহনগুলো এসব রাস্তা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ সড়ক-মহাসড়ক বেহাল অবস্থায় পতিত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার সড়কগুলোতেও ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করছে।
যানজট : ঈদে যানবাহনের চাপে আশুলিয়ার জিরাবো বাজার, ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে, সাভার বাইপাইল মোড়, গাজীপুরের চন্দ্রা মোড়, কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর, নবীনগর, কাঁচপুর, ভুলতা ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা-গোমতী সেতুর দুই প্রান্তে যানজট লেগেই থাকছে। এবার এর সঙ্গে আরও বহু পয়েন্ট যোগ হয়েছে। ঢাকা থেকে বের হতে গেলেই এসব পয়েন্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে থাকছে।
রেলস্টেশন : প্লাটফর্মে অসংখ্য যাত্রীর ট্রেনের জন্য অপেক্ষা, ট্রেন এলেই ঠেলাঠেলি করে ওঠা, তিল ধারণের ঠাঁই না থাকা ছিল গতকালের দৃশ্য। টিকিট সংগ্রহ করতে পারেননি তবুও ট্রেন যাত্রায় বাড়ি যাওয়ার জন্য শত শত মানুষকে কমলাপুর স্টেশনে অপেক্ষমাণ থাকতে দেখা গেছে। দিনাজপুরগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীরা জানান, ‘সড়কপথে পদে পদে বিপদ আর ঝুঁকি, আছে অতিরিক্ত যানজট। তাই তাত্ক্ষণিক টিকিট কেটে পুরো পথ দাঁড়িয়ে হলেও ট্রেনে যাওয়াটাই ভালো। ’ এদিকে ঢালাওভাবে স্ট্যান্ডিং টিকিট দেওয়ায় সিট পাওয়া যাত্রীদের নড়াচড়ারও উপায় থাকেনি। ট্রেনের ছাদে উঠেছেন দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনগুলো কানায় কানায় পূর্ণ দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ভিড় ছিল উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনগুলোতে। কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনের ছাদে কোনো যাত্রীকে উঠতে না দেওয়া হলেও প্লাটফর্ম পেরোতেই ট্রেনের ছাদে শত শত যাত্রী লাফিয়ে উঠতে থাকেন।
কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘লাইনের বিভিন্ন পয়েন্টে নানা রকম সমস্যা হওয়ায় ট্রেন আসতে দেরি হচ্ছে, তাই ছেড়ে যেতেও কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। বর্তমানে দুই লাইনের পরিবর্তে এক লাইনে ট্রেন চলাচল করছে। লাইন মেরামতের আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এদিকে সাম্প্রতিক বন্যায় যোগাযোগব্যবস্থার বেশি ক্ষতি হয়েছে দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, জামালপুর, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায়। এসব জেলার যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের কিছু অংশে এখনো রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিভিন্ন পয়েন্টে জরুরি মেরামতের পর রেললাইনের কিছু অংশে ডেড স্টপ করে মাত্র ৫ কিলোমটার বেগে ট্রেন চলছে। প্রায় প্রতিটি ট্রেনই চলছে দেরিতে। ’
নৌযাত্রা : ঈদযাত্রায় নৌপথেও স্বস্তির যাত্রা নিশ্চিত হয়নি। দেশের সবগুলো নদ-নদী এখনো উত্তাল। ছোট লঞ্চ চলা ঝুঁকিপূর্ণ। তীব্র সে াতে নদ-নদীগুলোতে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করছে। পানির তোড়ে ভেঙে পড়েছে পাড়, বিপর্যস্ত হচ্ছে নৌ-সংকেতব্যবস্থা। বন্যায় অতিরিক্ত বালু মিশ্রিত পানির সে াতে অনেক নৌপথেই ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো নৌযান চলাচলের জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা চালকদের সতর্কতার সঙ্গে নৌযান পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন।