সিলেট ১৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১ সালে। চার বছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। যদিও বিপিডিবি এজন্য সময় নিয়েছে এক যুগেরও বেশি। সময়ের পাশাপাশি বেড়েছে বাস্তবায়ন ব্যয়ও। ৩৪৩ কোটি টাকার প্রকল্প সম্পন্নে তারা ব্যয় করেছে ১ হাজার ৪ কোটি টাকা। আর্থিকভাবে ভঙ্গুর হওয়ার পরও এ ধরনের প্রকল্পকে বিপিডিবির বিলাসিতা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
আর্থিক খাতবহির্ভূত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসানে রয়েছে বিপিডিবি। গত আট বছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের কাছ থেকে গত সাত বছরে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণও ৩৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
সিলেটে ১৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মনে করছে সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিষয়ে আইএমইডির মূল্যায়ন বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় বেড়েছে ১৯৩ শতাংশ। একই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণও হয়েছে অস্বাভাবিক। বাস্তবায়নে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৩৩৩ শতাংশ সময় বেশি ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় একাধিকবার সংশোধন করতে হয়েছে বিশদ প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি)। তবে দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপি থেকেও প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১২৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আইএমইডিতে প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন (পিসিআর) পাঠানোর নিয়ম থাকলেও তা পাঠানো হয় দেড় বছর পর। তাতে দরপত্র আহ্বানের তারিখ, ক্রয় চুক্তিমূল্য, কাজ সম্পাদনের তারিখসহ প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যই দেয়নি বিপিডিবি।
জানা গেছে, ‘সিলেট ১৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট সঞ্চালন গড়ে তোলা’ শীর্ষক প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন দেয়া হয় ২০০১ সালের এপ্রিলে। বাস্তবায়নে মেয়াদ ধরা হয় ২০০১ সালের জুলাই থেকে ২০০৪ সালের জুন পর্যন্ত। আর ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ৩৪২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। পরবর্তীতে দুই দফায় ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮৭৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এতে বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০০১ সালের জুন থেকে ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত। যদিও প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে।
বৈদেশিক অর্থায়ন প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা ও টার্নকি অংশের দরপত্র আহ্বানে জটিলতার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ হয়েছে বলে দাবি বিপিডিবির। পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিলম্ব ও মামলাকেও এজন্য দায়ী করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিপিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রক্রিয়াগত বিভিন্ন জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। আর ব্যয়ের বিষয়টিতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই অনুমোদন নেয়া হয়েছে।
যদিও বিপিডিবির মতো আর্থিকভাবে ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এসব প্রকল্প বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম. তামিম। তিনি বলেন, শুধু বিপিডিবি কেন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই এমন দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়ন কাম্য নয়। অনেক দেশেই প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা দেখা দিলে তা বাতিল করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে মাঝপথেও প্রকল্প বাতিলের নজির আছে। কারণ এতে লোকসানের যে ঝুঁকি থাকে, তা বহন করার চেয়ে প্রকল্প বাতিল করা শ্রেয়। তবে এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি বিপিডিবিকে দেয়া ঋণের বিষয়টিতেও স্বচ্ছ একটি অবস্থান নেয়া উচিত।
বিপিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান হয় ৬৩৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকায়। পরের অর্থবছরে লোকসান আরো বেড়ে হয় ৬ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কিছুটা কমলেও ৫ হাজার ২৬ কোটি টাকা লোকসান করে সংস্থাটি। এরপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৮০৬ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ হাজার ২৮২ কোটি ও ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৩ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা লোকসান করে বিপিডিবি। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ৫ হাজার ১৪১ কোটি টাকা।
লোকসানের পাশাপাশি সংস্থাটিতে সরকারের ঋণও বাড়ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিপিডিবিতে সরকারের ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ থাকলেও ২০১০-১১ অর্থবছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ১১৬ কোটি টাকায়। এছাড়া ২০১১-১২ অর্থবছরে সংস্থাটিকে সরকার ঋণ দেয় ৬ হাজার ৬৪০ কোটি, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৯৩৯ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭১৭ কোটি ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিপিডিবিতে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা।
বিপিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে মোট বিদ্যুতের ৬২ শতাংশ আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে আসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ২১ শতাংশ। এছাড়া ডিজেল থেকে ৮ দশমিক ৭৮ ও কয়লা থেকে ২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ভারত থেকে আমদানি করা হয় বাকি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহূত বিভিন্ন জ্বালানির মধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী প্রাকৃতিক গ্যাস। গ্যাসভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ২ টাকারও কম। এর পরই রয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ। জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে ৬ টাকা। আর সবচেয়ে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ। কিন্তু বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ফলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, বাড়ছে বিপিডিবির লোকসানও।