পর্যবেক্ষক দিয়ে চলছে এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক

Slider অর্থ ও বাণিজ্য জাতীয়

base_1502571037-base_1502564914-13

পরিচালকদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক চাপে সুশাসন ভেঙে পড়েছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংকে। অনিয়মের কারণে নাজুক অবস্থায় পড়া এক-চতুর্থাংশ বা ১৪টি ব্যাংকে এরই মধ্যে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না খেলাপি ঋণের হার। আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে প্রতিনিয়তই আলোচনায় আসছে দেশের কোনো না কোনো ব্যাংকের নাম। ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসনের অভাবে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তারাও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক চাপের কারণে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির রাশ টানা যাচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বৈত শাসনের কারণে এসব ব্যাংকে অনিয়ম করেও অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদে থাকায় এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ক্ষমতার সবটুকু প্রয়োগ করতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাতে আরো বড় বিপর্যয় নেমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমানে দেশে সরকারি, বেসরকারি, বিদেশীসহ কার্যক্রমে আছে মোট ৫৭টি তফসিলি ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ছাড়া সবক’টিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ৪০টি ব্যাংকের মধ্যেও সাতটিতে পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে। আইসিবি ইসলামিক, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ইসলামী ব্যাংক, নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পর্ষদে গত বছর পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ৩ মে নতুন করে পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে বেসরকারি এবি ব্যাংকে। চলতি বছরে আরো একাধিক বেসরকারি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন। তবে দেশে কার্যরত বিদেশী নয়টি ব্যাংকের কোনোটিতেই পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ডুবতে বসেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিলে কী পরিণতি হয়, তা আমরা বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে দেখেছি। ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের দায়দায়িত্ব কী হবে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু সে নীতিমালা এখন আর সেভাবে পরিপালন হচ্ছে না। ফলে ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে পরিচালকরা হস্তক্ষেপ করছেন। অনিয়মে জড়িয়ে পড়া ব্যাংকগুলোয় শুধু পর্যবেক্ষক দিলেই হবে না, তাদের প্রতিবেদনের আলোকে কঠোর ব্যবস্থাও নিতে হবে। পরিস্থিতি উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত হতে হবে। অন্যথায় দিন দিন পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে।

নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবার আগে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় ফারমার্স ব্যাংকে। অনিয়ম রোধ ও আর্থিক পরিস্থিতির উন্নয়নে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মহীউদ্দীন খান আলমগীর। পর্যবেক্ষক নিয়োগের পরও ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার তেমন একটা উন্নতি হয়নি। চলতি বছরের মার্চ শেষে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ফারমার্স ব্যাংকের।

নতুন প্রজন্মের আরেক ব্যাংক এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকে বিশদ পরিদর্শন চালিয়ে ৭০১ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মসহ ১০ ধরনের ব্যত্যয় খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। আর চলতি বছরের ২০ মার্চ নতুন প্রজন্মের ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর নোটিস পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। এনআরবিসির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত্ আলী যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ কোটি টাকার বেশি।

ব্যবসায়ী জয়নুল হক শিকদারের পরিবার দিয়ে চলছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সুশাসনের ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় ২০১৪ সালে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্যবেক্ষক বসানোর পরও ব্যাংকটির চারজন এমডিকে মেয়াদপূর্তির আগেই ব্যাংক ছাড়তে হয়েছে। মার্চ শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের খাতায় চলে গেছে, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

পরিচালকদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ২০০৪ সালে বড় ধরনের সংকটে পড়ে তত্কালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে প্রশাসক বসায় ব্যাংকটিতে। ২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সব সম্পত্তি ও দায় নিয়ে নতুনভাবে যাত্রা করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। দীর্ঘদিনেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকটি। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ৯৫২ কোটি টাকার মধ্যে ৬৭৬ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। এ হিসাবে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৭১ শতাংশই খেলাপি। বছরের পর বছর লোকসানে চলছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। ২০১৬ সালেও ব্যাংকটি ২৭ কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ তোলার পর ২০১০ সালে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের শুরুতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। দেশের বেসরকারি খাতের সর্ববৃহত্ ব্যাংকটির মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণকৃত ঋণের সাড়ে ৫ শতাংশ।

বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ে পড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ার কিনে নিয়েছে একটি শিল্প গ্রুপ। সুশাসনের ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় বেশ আগ থেকেই ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক বসিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির মালিকানায় পরিবর্তন এলেও আর্থিক সূচকে কোনো উন্নতি হয়নি। মার্চ শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ২৮৯ কোটি টাকার। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৩৮ শতাংশ চলে গেছে খেলাপির খাতায়।

অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা, পরিচালনা পর্ষদে সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে চলতি বছরের ৩ মে বেসরকারি এবি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চ শেষে এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা এ প্রসঙ্গে বলেন, কোনো ব্যাংকের পর্ষদে বিভক্তি বা সুশাসনের ঘাটতি দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিচ্ছে। ১৪ ব্যাংকের পর্ষদে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা পর্ষদ সভায় অংশ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি যাতে না হয়, সেটি নিশ্চিতের চেষ্টা করছেন।

বছরের পর বছর ধরে চলা অনিয়ম বন্ধে ২০১৪ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে প্রতি বছর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রাও বেঁধে দেয়া হয়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ২০১৫ সালের নভেম্বরে একযোগে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে। এর পরও ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংকট বাড়ছে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, কয়েক বছর আগে সংঘটিত অনিয়মের জের এখনো টানতে হচ্ছে সোনালী ব্যাংককে। আমরা সম্মিলিতভাবে ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি উন্নতির চেষ্টা করছি। বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক খেলাপি ও বড় ধরনের মূলধন ঘাটতির কারণে সোনালী ব্যাংকের পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *