মজুরিবৈষম্যে চাতালের ৬০% নারী শ্রমিক

Slider জাতীয়

মজুরিবৈষম্যে চাতালের ৬০% নারী শ্রমিক

base_1501183846-4

দিনাজপুরের মহাবলীপুরের একটি চাতালে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন জরিনা বেগম ও আজহার উদ্দিন। ধান পরিষ্কার, বয়লারে তুষ দেয়া, ধান সিদ্ধ ও শুকানোর কাজ করে রহিমা বেগম মজুরি পান দৈনিক ১৫০ টাকার কিছু বেশি। কাজে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও আজহার উদ্দিন মজুরি পাচ্ছেন দৈনিক ২৫০ টাকার বেশি।

জরিনা বেগমের মতোই অবস্থা সারা দেশের চাতালে কর্মরত প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী শ্রমিকের। প্রায় একই ধরনের কাজ করেও পুরুষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। মজুরিবৈষম্যের এ তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) সাম্প্রতিক এক গবেষণায়ও। তারা দেখিয়েছে, চাতালে নারী শ্রমিকের ৬০ শতাংশই উচ্চমাত্রার মজুরিবৈষম্যের শিকার। এসব নারী শ্রমিক দৈনিক গড়ে ১৩৬ টাকা মজুরি পেলেও পুরুষরা পাচ্ছেন ১৮৫ টাকা।

দেশে চাতালের বড় অংশের অবস্থান উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলায়। বণিক বার্তার পক্ষ থেকে এসব জেলায় অনুসন্ধান করে জানা গেছে, অঞ্চলভেদে পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারীরা ২৫-৪৫ শতাংশ কম মজুরি পাচ্ছেন।

উত্তরাঞ্চলীয় জেলা জয়পুরহাটে চাতাল রয়েছে প্রায় ৫১০টি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব চাতাল শ্রমিকদের ৬০ শতাংশই নারী। মজুরি হিসেবে তারা পাচ্ছেন দৈনিক ২০০ টাকা। অথচ পুরুষ শ্রমিকরা পাচ্ছেন ২৫০ টাকা।

দেশে চালের বড় জোগানদাতা নওগাঁয় চাতাল রয়েছে ১ হাজার ১৪০টি। এর মধ্যে ৫০০টির মতো চাতাল চালু রয়েছে। এসব চাতালে পুরুষ শ্রমিকদের গড় মজুরি দৈনিক ২৮০ টাকা। এর বিপরীতে নারী শ্রমিকরা পাচ্ছেন ১৭০ টাকা।

এ বিষয়ে নওগাঁর মহাদেবপুর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম মোস্তফা জানান, নারীরা পুরুষের মতো ধান সিদ্ধ ও ধান ভাঙার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন না বলে তাদের মজুরি তুলনামূলকভাবে কম।

বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত চাতালের সংখ্যা ১ হাজার ৯৩৫। এর বাইরে ছোট-বড় মিলে চাতাল রয়েছে প্রায় তিন হাজার। এ জেলায় চাতাল শ্রমিক আনুমানিক ২০ হাজার। প্রতি মণ ধান সিদ্ধ ও শুকানো বাবদ ২০ টাকা করে পান নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। তবে কিছু কিছু চাতালে নারীরা ২০ মণ ধান সিদ্ধ করে মজুরি পান ২০০ টাকা। ধান সিদ্ধ করার পরও তাদের পুরুষ শ্রমিকদের সহযোগিতা করতে

হয়। আবার লট হিসেবে চুক্তিতে একজন নারী শ্রমিক ২০০ থেকে ৪০০ মণ পর্যন্ত ধান সিদ্ধ ও শুকানোর কাজে সহযোগিতা করে মজুরি হিসেবে পান ১৫০ টাকা ও সাত কেজি চাল। এ চুক্তিতে পুরুষ শ্রমিকরা পান লট হিসেবে ৭০০-৮০০ টাকা।

দিনাজপুর খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় নিবন্ধিত চাতাল রয়েছে প্রায় ২ হাজার ২৬৪টি। এসব চাতালের শ্রমিক সংখ্যা ২৬ হাজার ৪০০। এসব শ্রমিকের আবার ৬০ শতাংশই নারী। ধান পরিষ্কার করা, বয়লারে তুষ দেয়া, ধান সিদ্ধ ও শুকানোর কাজ করতে হয় নারী শ্রমিকদের। এর বিনিময়ে তারা দৈনিক ১৮০-২১০ টাকা হিসেবে মজুরি পান। অন্যদিকে পুরুষ শ্রমিক আয় করেন দৈনিক ২৫০-৩০০ টাকা।

পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পাওয়ার বিষয়ে দিনাজপুরের গোপালগঞ্জ গ্রামের নারী শ্রমিক রহিমা বেগম জানান, পুরুষ শ্রমিকদের সমান কাজ করেও তাদের তুলনায় মজুরি কম পাই আমরা। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও সমান মজুরি দেয়া হয় না আমাদের।

দীর্ঘদিন ধরে চাতালের নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন মহিলা শ্রমিক লীগের দিনাজপুর শাখার সভানেত্রী রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, পুরুষের সমান কাজ করলেও তাদের তুলনায় কম মজুরি দেয়া হয় নারীদের।

রংপুর জেলা চালকল সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সক্রিয় চাতাল রয়েছে প্রায় ৪৫০টি। এসব চাতালে শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৬০০, যাদের অর্ধেকই নারী। এখানকার নারী শ্রমিকরা এক মৌসুমে এককালীন ৬ হাজার টাকা করে মজুরি পান।

মজুরিবৈষম্য নিয়েই কাজ করছেন কুষ্টিয়ার নারী চাতাল শ্রমিকরাও। জেলার খাজানগরের একটি খুপরি ঘরে স্বামী-সন্তান নিয়ে বাস করেন চাতাল শ্রমিক সাবিহা খাতুন। রান্না, খাওয়া, শোয়া সবই চলে ওই ঘরে। চাতালে কাজ করে যে মজুরি পান, তা দিয়ে এর চেয়ে ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ নেই তার। সারা দিন কাজ করেও মজুরি হিসেবে পান দৈনিক ১৫০ টাকা। অথচ একই কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিক পান ২০০ টাকার বেশি।

রাবেয়া খাতুন বলেন, একটা চালানের ধান থেকে চাল তৈরির কাজ ক’দিনে শেষ হয় বলা যায় না। বৃষ্টি হলে বসে থাকতে হয়। এ সময় পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে ঋণ করতে হয় চড়া সুদে। মজুরি যা পাই, তা দিয়ে ঋণ শোধ করতে না করতেই আবার ঋণ নেয়ার সময় চলে আসে। এ বৃত্ত থেকে বের হওয়ার উপায় নেই।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বগুড়া প্রতিনিধি এইচ আলিম, রংপুরের এসএম পিয়াল, নওগাঁর এবাদুল হক, কুষ্টিয়ার হাসান আলী ও দিনাজপুরের রফিকুল ইসলাম ফুলাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *