ঢাকার চার নদীদূষণে ৩ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি গ্রাম বাংলা

base_1500750517-1বুড়িগঙ্গা নদীদূষণের দায়ে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ২৩টি কারখানাকে ৫২ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট উইং। দীর্ঘদিন ধরে নদীতে সরাসরি বর্জ্য ফেলে আসছিল রাজধানী ঢাকার সাঁতারকুল, বাড্ডা ও কেরানীগঞ্জে অবস্থিত এসব কারখানা।

শুধু এই ২৩ কারখানা নয়, ঢাকার চারপাশের নদীতে সরাসরি বর্জ্য ফেলছে প্রায় তিন হাজার শিল্প-কারখানা। নদীদূষণের দায়ে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৮৯১টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। বিভিন্ন সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে এসব প্রতিষ্ঠানকে ২৩৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। ধার্যকৃত জরিমানার মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত ১৪৭ কোটি টাকা আদায়ও করা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিমানার মুখে পড়া কারখানার মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ওয়াশিং, ডায়িংসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানাও। দীর্ঘদিন ধরে কেরানীগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন ডায়িং ও ওয়াশিং কারখানা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নির্মাণ না করেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইটিপি নির্মাণের জন্য বহুবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও মালিকপক্ষ তাতে কর্ণপাত না করে ওয়াশিং ও ডায়িং কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলছে। এতে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে নদীর পানি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ১৩ ফেব্রুয়ারির ওই অভিযানে ১১টি ওয়াশিং কারখানা সিলগালাসহ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এছাড়া ঢাকার সাঁতারকুল ও বাড্ডার আশরাফ ওয়াশিংকে ৬ লাখ এবং শাইনিং ওয়াশিংকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

তবে শুধু শিল্প-কারখানাগুলোকে জরিমানা করে নদীদূষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. খলিলুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, জরিমানা করে আসলে নদীদূষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জরিমানা গুনে দূষণকারী সহজেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। যদি এর সঙ্গে আরো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে এ ধরনের প্রবণতা কমতে শুরু করবে। নদীদূষণ প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি।

ঢাকার কেরানীগঞ্জে ছোট-বড় পাঁচ হাজারেরও বেশি গার্মেন্টস কারখানা আছে। এছাড়া রয়েছে ৮০টি ওয়াশিং কারখানা। ওয়াশিং মালিক সমিতির দেয়া তথ্য বলছে, এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন ২০-২৪ লাখ লিটার তরল বর্জ্য সরাসরি অপরিশোধিত অবস্থায় পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। পাশেই শ্যামপুর শিল্প এলাকার ৫৯টি প্রিন্টিং অ্যান্ড নিট-ডায়িং কারখানা থেকে প্রতিদিন বের হয় ২৫ হাজার ৫৮২ ঘনমিটার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য, যা সরাসরি পড়ছে নদীতে। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভারী ধাতু মিশছে নদীর পানিতে।

ট্যানারি শিল্পের দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গা রক্ষায় হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাভারের হেমায়েতপুরে। কিন্তু সেখানে গিয়েও নতুন করে ধলেশ্বরী নদীকে দূষিত করছে এ শিল্প। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ করা হলেও তা সঠিকভাবে বর্জ্য পরিশোধন করতে পারছে না। ইপিজেডে স্থাপন করা সিইটিপিগুলোরও একই অবস্থা। টঙ্গী এলাকায় থাকা ডায়িং ও ওয়াশিং কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য দূষিত করেছে তুরাগ নদকে। ওয়াশিং কারখানার বর্জ্য সরাসরি পরিবেশে ছাড়া হচ্ছে নরসিংদীতেও।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইটিপি না থাকায় ওয়াশিং কারখানার শতভাগ দূষিত বর্জ্য সরাসরি পরিবেশে গিয়ে মিশছে। আবার অনেক শিল্প-কারখানায় ইটিপি থাকলেও তা বন্ধ রেখেও বর্জ্য সরাসরি পানিতে ফেলছে কর্তৃপক্ষ। এতে দূষিত হচ্ছে কারখানার আশপাশের পরিবেশ।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীদূষণ রোধে নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্সটি নিয়মিত সভা আয়োজনসহ করণীয় বিষয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে  বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। শিল্পবর্জ্য হ্রাসের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে তরল বর্জ্য নির্গমনকারী সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে জিরো ডিসচার্জ পলিসি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে তার সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, চারপাশের নদ-নদী, বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা রক্ষা করতে না পারলে ঢাকার পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। এমনিতেই বাস অযোগ্য নগরীর তালিকায় উঠে গেছে ঢাকার নাম। কাজেই বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তুলতে হলে পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় নদ-নদী দূষণ ও দখলমুক্ত রাখার বিকল্প নেই। যেসব শিল্প-কারখানা নির্দেশনা মানবে না, সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। সেই সঙ্গে জোরদার করতে হবে মনিটরিং ব্যবস্থা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কঠোর হলে নদ-নদী দখল ও দূষণমুক্ত হবে।

এ বিষয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ বলেন, যেকোনো মূল্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে। দূষণকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে ১ শতাংশ ইকোট্যাক্স আরোপের বিষয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হবে। দূষণের দায়ে কোন কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্যাক্স আরোপ হবে, তা অর্থ মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *