কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পঞ্চম প্রয়াণ দিবস আজ। ২০১২ সালের এদিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি। দিবসটি উপলক্ষে নুহাশপল্লীতে নানা আয়োজন করা হয়েছে। অসংখ্য হুমায়ূনভক্তের সঙ্গে বরাবরের মতো এবারো সকাল থেকেই সেখানে উপস্থিত থাকবেন হুমায়ূনপত্নী, অভিনেত্রী-নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওন। দুই পুত্র— নিশাদ-নিনিতকে নিয়ে কীভাবে কাটছে তার দৈনন্দিন জীবন কিংবা কীভাবে হুমায়ূন আহমেদ তার স্মৃতিতে এসে ধরা দেয়, টকিজের পাঠকদের সামনে সেসবই তুলে ধরলেন শাওন—
‘প্রয়াণ দিবস’। দিনটি সবার জন্য বিশেষ কিছু হলেও যার প্রিয়জন চলে যায়, তার অনুভূতি কি শুধু এই একটি দিনের মধ্যেই আটকে থাকে! একটা পরিবারে সন্তানের কাছে বাবা না থাকা, স্ত্রীর কাছে প্রিয় সঙ্গী না থাকার বেদনা, তাদের চলার পথের প্রতিনিয়ত যে নিঃসঙ্গতা, সেটা সেই পরিবারের চেয়ে আর কে অনুধাবন করতে পারে।
১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ দিবস বলে নয়; তার প্রতি আমার, আমার সন্তানদের অনুভূতি প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের। আমরা তাকে চাইলেই আমাদের মধ্যমণি করতে পারি না, চাইলেই চারজন একসঙ্গে বসে গল্প করতে পারি না— কোনোভাবেই বোঝাতে পারব না, প্রতি মুহূর্তের এ শূন্যতা আমাদের কতটা কষ্ট দেয়।
হুমায়ূনকে স্মরণ করে তাকে নিয়ে সবাই বিশেষভাবে অনুষ্ঠান পালন করে। কিন্তু আমি আমার জীবনসঙ্গী হারিয়ে, আমার সন্তান তার বাবাকে হারিয়ে সেদিন বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারি না। প্রতিটা দিনই আমাদের একেকটা সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়। আগামীকাল (আজ) হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলবেন, অনেক কিছু লিখবেন, শ্রদ্ধা জানাবেন, আমাকে ও তার সন্তানদের সমবেদনা জানাবেন। কিন্তু সাধারণ একটি দিনে আমাকে কে সান্ত্বনা দেবে, আমার দুটো ছোট বাচ্চাকে কে বোঝাবে তাদের বাবার অনুপস্থিতির কথা!
আজ (গতকাল) ওদের (হুমায়ূন-শাওনপুত্র নিনিত-নিশাদ) বিদ্যালয় থেকে একটি ফর্ম পাঠিয়েছে। সেখানে মা-বাবার নাম ও তাদের সেলফোন নম্বর চাওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যখন ওর বাবার নাম লিখতে হয়, তার ফোন নম্বর দিতে পারি না, সেটাই তো আমার অনুভূতি। এটা কীভাবে বোঝাব! আবার প্যারেন্টস মিটিংয়ে সব বাচ্চার সঙ্গে ওদের মা-বাবা যায়, কিন্তু নিনিদ-নিশাদের সঙ্গে আমি একা যাই। এটাই তো আমার অনুভূতি। মোটকথা, এটা আমাদের আজীবনের অনুভূতি, প্রতিদিনের অনুভূতি। এ অনুভূতির মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত!
অবশ্য শুধু আমার কেন, আমাদের সন্তান কেন, ওদের মতো যারা বাবা হারিয়েছে; সব পরিবারের একই রকম অনুভূতি। আমি হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী বলে আমার অনুভূতি অন্য রকম, আর সাধারণত একজন নারীর অনুভূতি আরেক রকম, সেটা তো হতে পারে না। একজন সাধারণ নারী তার প্রয়াত স্বামীকে যেভাবে স্মরণ করে, সাধারণভাবে তার বাচ্চারা যেভাবে স্মরণ করে, সেভাবে আমরাও করি।
আমি যদি আমার বাচ্চাদের মনের ভেতর ঢুকতে পারতাম, তাহলে হয়তো আরো ভালো বুঝতে পারতাম, ওদের বাবাকে না দেখার, বাবাকে কাছে না পাওয়ার হাহাকারটা। কিন্তু চাইলেই তো পারি না। সে ক্ষমতা বিধাতা আমাদের কোনো কারণে হয়তো দেননি। তবে বাবাকে নিয়ে ওদের যে কিছু একটা অনুভূতি হয়, সেটা মা হিসেবে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি ওদের বাবাকে নিয়ে ওদের ভেতর আলাদা একটা জগত্ আছে, রঙ আছে।
সত্যি বলতে, আমার সন্তানরা যখন তাদের বাবার ছবি দেখে, এমনো ছবি আছে, যেগুলো ওরা আমার কোলে বসে ওদের বাবাকে দেখছে। ওগুলো দেখে হয়তো কিছু একটা ওরা ভাবে। কিন্তু চাইলেই যে প্রশ্ন করা যায় না, এটুকুও ওরা এত দিনে বুঝে গেছে। ওরা এখন আর বাবার ছবির সামনে গিয়ে প্রশ্ন করে না। আমার কাছে মনে হয়, কীভাবে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা কাছে না থাকলেও সে আছে, এটা ভেবে এগোতে হয়, সেটা আমি সবসময়ই ওদের কাছ থেকে শিখেছি।
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ— এসব অভিধা বাদ দিয়ে যদি সঙ্গী হুমায়ূন আহমেদ আমার সঙ্গে থাকত, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া হতো। না থেকেও আছে— এ ভাবনার বাইরে গিয়েও ইচ্ছা হয়, যদি চোখের সামনে দেখতে পেতাম। তার চলে যাওয়ার দিন সংখ্যা যতই বাড়ছে, ততই চোখের সামনে তাকে দেখতে ইচ্ছা করে।
নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদ যেত। নিজের হাতে রোপণ করা গাছগুলোর পাতা ধরে ধরে দেখত, কথা বলত। অদ্ভুতসব প্রশ্ন করত, ‘তুই হঠাত্ করে হলুদ হয়ে গেলি কেন? তুই কুঁকড়ে যাচ্ছিস কেন?’ আমার কাছে পুরো বিষয়টাই তখন পাগলামি মনে হতো। আমি নিজেও গাছগুলোর সঙ্গে ওভাবে মিশতে পারতাম না। বরং এখন মনে হয়, আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি মিশতে পারি ওদের সঙ্গে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি না, কিন্তু হাতে লাগানো গাছগুলোর সঙ্গে পারি তো! আবার কখনো মনে হয়, গাছগুলো আমার চেয়ে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। ওরা অন্তত হুমায়ূন আহমেদকে আগলে রাখতে পেরেছে, তার সঙ্গে সারা দিন থাকতে পারছে।