লন্ডনে দেড় ঘণ্টায় ৫ এসিড হামলা

Slider সারাবিশ্ব

74111_f66লন্ডনে মোটরসাইকেলে (মোপেড) চড়ে দুই লোক মাত্র ৯০ মিনিটের মধ্যে ৫টি এসিড হামলা চালিয়েছে। লন্ডন পুলিশ বলেছে, এসিড লেগে একজন ভিকটিমের মুখে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে পূর্ব লন্ডনে এসব ঘটনা ঘটে। দৃশ্যত, ৫টি হামলাই একই সূত্রে গাঁথা। দুই ভিকটিমের মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। এ খবর দিয়েছে ইন্ডিপেনডেন্ট।
খবরে বলা হয়, গুরুতর এই শারীরিক হামলা ও ডাকাতির অভিযোগে এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে পূর্ব লন্ডনের একটি পুলিশ স্টেশনে নেয়া হয়েছে।
৩২ বছর বয়সী এক মোটরসাইকেল চালককে দিয়ে হামলার শুরু। হামলাকারী ওই দুইজন কুইন্সব্রিজ রোডের হ্যাকনি রোড সংযোগে তার দিকে এগিয়ে যায়। এরপরই দুই সন্দেহভাজন তার মুখে এসিড ছুড়ে মারে। এরপর এদের একজন তার মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যায়। পুলিশ জানায়, ওই ভিকটিম এরপর একটি স্থানীয় হাসপাতালে যেতে সমর্থ হন।
২০ মিনিটেরও কম সময় পরে সকাল ১০.৫০ মিনিটে আরেক ভিকটিমের গায়ে এসিড ছুড়ে মারে ওই হামলাকারী যুগল। এবার ঘটনাস্থল ইসলিংটনের হাইবুরি কর্নারের আপার স্ট্রিট সংযোগ। পরে উত্তর লন্ডনের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ভিকটিমকে।
সকাল ১১.০৫ মিনিটে, দ্রুতগতিতে এগোতে থাকা দুই হামলাকারী শোরেডিচ হাই স্ট্রিটে এক লোককে এসিড মারে। পুলিশ জানিয়েছে, এই ব্যক্তির ক্ষত গুরুতর নয়। মাত্র ১৫ মিনিট পরই তারা দৃশ্যত আরেকটি হামলা চালায়। কেজনোভ সড়কে এক লোক তাদের হামলার শিকার হয়। পুলিশ জানিয়েছে, তার মুখের ক্ষতের অবস্থা ‘লাইফ চেঞ্জিং’। দ্য সান পত্রিকা জানিয়েছে, স্থানীয় বাসিন্দা স্যামুয়েল এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি জানান, এসিড মারার পর নিজের মুখ ধরে যন্ত্রণায় ছটফট ও চিৎকার করছিলেন এই ভিকটিম। তিনি জানান, হামলার পর পর অনেক মানুষ এগিয়ে এসে তার মুখে পানি দিতে শুরু করে।
সর্বশেষ হামলার ঘটনা ঘটে ১১.৩৭ মিনিটে। চ্যাটসওর্থ সড়কে নিজের মোটরসাইকেলে বসে থাকা এক ব্যক্তির ওপর এসিড ছুড়ে ওই দুই জন। এরপর তার মোটরসাইকেল নিয়ে তারা পালিয়ে যায়।
লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘তদন্ত চলছে। হ্যাকনি সিআইডির কর্মকর্তারা বিষয়টি তদন্ত করছেন।’ পুলিশ প্রত্যক্ষদর্শীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে।
খবরে বলা হয়, এই হামলা এমন সময়ে হলো যখন মাত্র কয়েকদিন আগেই এক বৃটিশের বিরুদ্ধে উঠতি মডেল ও তার কাজিনকে এসিড নিক্ষেপের অভিযোগ আনা হয়। রেশাম করিম ও জামিল মুখতারের ক্ষতের অবস্থা গুরুতর। তারা উভয়েই মুসলিম। পূর্ব লন্ডনের বেকটনে রেশাম নিজের জন্মদিন পালন করছিলেন তখন। জন টমলিন নামে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর শারীরিক ক্ষতি করার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এ বছর লন্ডনে গণহারে এসিড হামলার ঘটনা আগেও ঘটেছিল। ইস্টার মানডেতে লন্ডনের একটি নাইট ক্লাবে জড়ো হওয়া মানুষজনের ওপর এসিড মারা হয়। দুইজন এতে অন্ধ হয়ে যান। বাকিদের চেহারা বিকৃত হয়ে যায়।
এদিকে, লন্ডনে দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে ৫টি এসিড হামলার পর প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে এই অপরাধ মোকাবিলায় নতুন আইন প্রণয়নের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাম্প্রতিক এই হামলা এবং শাস্তির বিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি-না জানতে চাওয়া হলে তেরেসা মে’র মুখপাত্র জানান, প্রধানমন্ত্রী এই এসিড হামলাকে ‘ভয়ঙ্কর’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে এসিড বা ক্ষয়কারী বস্তু (করোসিভ সাবসটেন্স) বহন করা অপরাধ। আর এগুলো কেউ ব্যবহার করলে তা ‘মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি’ ও ‘শারীরিক ক্ষতির উদ্দেশ্যে হামলা’র মতো গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিচারের আওতায় আসতে পারে। আমরা এর চেয়ে বেশি কি করতে পারি তা খতিয়ে দেখতে পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি।’
ওদিকে, ইস্টহ্যামের লেবার দলের এমপি স্টিফেন টিমস এসিড বহনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই বিষয়ে সোমবার বৃটিশ পার্লামেন্টে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। এ সংক্রান্ত অপরাধ মোকাবিলায় দ্রুতই আইন সংশোধনের তাগিদ দেন তিনি। প্রসঙ্গত, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, পুলিশ কাউকে এসিড বহন করা অবস্থায় পেলে তাদের প্রমাণ করতে হবে যে, এসিড বহনকারীর ক্ষতি করার উদ্দেশ্য রয়েছে। অপরাধ সংঘটনের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, বৃটেনে এসিড ব্যবহার করে হামলার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৬ সালে লন্ডনে ৪৫৫টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে যেখানে এসিড বা এসিডের মতো ক্ষয়কারী বস্তু সরাসরি বা হুমকি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
‘আমার বাচ্চারা এ রাস্তা দিয়ে স্কুলে যায়’; শঙ্কিত স্থানীয় নিবাসীরা: ভয়ঙ্কর এসিড হামলার পর ইস্ট লন্ডন নিবাসীরা চরম উদ্বেগ আর শঙ্কায় রয়েছেন। এসিড হামলা হওয়া চার এলাকা হ্যাকনি, শোরডিচ, স্টোক নিউয়িংটন ও আইলিংটনের আসে পাশের নিবাসীরা বলছেন, তাদের ‘শান্তিপূর্ণ’ এলাকাগুলোতে এমন হামলা আবারও ঘটতে পারে বলে তারা শঙ্কা বোধ করছেন। ভবিষ্যতে এমন হামলা প্রতিহত করতে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান নিবাসীরা।
তৃতীয় হামলার স্থান থেকে কয়েক মিটার দূরে ক্যাজিনোভ রোডে থাকেন দুই সন্তানের মা সাহার সারভারি। তিনি বলেন, এখন ওই এলাকাতে থাকতেই ভীত সন্ত্রস্ত বোধ করছেন। ইন্ডিপেন্ডেন্টকে সাহার বলেন, ‘এ এলাকায় এমন কিছু কখনও ঘটেনি। আমি এই রাস্তায় ১১ বছর ধরে আছি। সত্যিই শান্ত একটা এলাকা এটা। কিন্তু এখন আমি ভীতসন্ত্রস্ত আমার দুই বাচ্চার বয়স ৯ ও ৬। তারা এ রাস্তা দিয়ে স্কুলে যায়।’
কাছেই থাকেন মুসলিম এক ব্যক্তি। নিজের নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি এখন শঙ্কিত। এটা দারুণ একটি আবাসিক এলাকা। এখানে এমন কিছু কখনও ঘটতে দেখবেন না। এই রাস্তা দিয়েই আমার বাচ্চারা স্কুলে যায়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমার স্ত্রী আজ আমাকে বললো সাবধানে থাকতে। এটা সত্যিই ভীতিকর। সচরাচর শোনা যায় এসিড হামলা হেটক্রাইমের সঙ্গে সংযুক্ত। এবারেরটা তেমন মনে হচ্ছে না তবে এটা সত্যিই উদ্বেগের।’
সাম্প্রতিক এসিড হামলা নিয়ে প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক চ্যানেল আই ইউকে’র বার্তা সম্পাদক মুনজের আহমেদ চৌধুরী গতকাল মানবজমিনকে বলেন, গত জুনে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক রেশাম খানের গাড়িতে এসিড নিক্ষেপের ঘটনার মধ্য দিয়ে সামপ্রদায়িক ওই হিংস্রতার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে রেশাম খানের ওপর এসিড হামলার ঘটনাটি বৃটেনের মিডিয়ায় প্রথম এবং ব্যাপক প্রচার পায়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক অধুষ্যিত পুর্ব লন্ডনের রাস্তায় হামলাটি হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সুপার শপ, রাস্তা, পার্কে আচমকা হামলা বা হামলার চেষ্টার বহু ঘটনা ঘটেছে। এতে অনেকে আহত হয়েছে। শুরুর দিকে বিষয়টি স্পষ্ট না হলেও এখন বিষয়টি ওপেন-সিক্রেট যে এটি সাম্প্রদায়িক হামলা। লন্ডন ও মানচেষ্টারে মুসলিম নামধারী উগ্রপন্থিদের হামলার পর থেকে প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের কারণে নিরীহ মুসলিমদের টর্গেট করা হচ্ছে। সেখানে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন নারী ও তরুণীরা। এটি গোটা মুসলিম কমিউনিটি বিশেষত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা এবং চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে, যা বৃটেনে কখন কল্পনাই করা যেতো না। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বৃটেনের মত দেশে এসিড সহজলভ্য হয়ে যওয়া! এটি মুসলিম বিদ্বেষী উগ্রপন্থিদের হাতে হাতে রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ ধরনের হেইট ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে লন্ডনের প্রশাসনও উদ্বিগ্ন। একটি কথা আজ সবাই বলছেন, উগ্রপন্থার সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মুসলমান বা ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *