টানাটানিতে ম্লান ঈদ

Slider সারাদেশ

71292_f1

 

 

 

 

 

ঢাকা: কালো মেঘে আকাশ ঢাকা। মানুষের মুখে হাসি নেই। আগাম বন্যা গিলে খেয়েছে ফসল। হাওরে হাওরে বইছে কান্না। দুঃখ নিয়ে তাদের পথচলা। নিত্যদিনের খাবার যোগাতেই তাদের ত্রাহি অবস্থা। অন্যদিকে সেই রেশ কাটতে না কাটতেই অতি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে দেশে চলছে স্বাভাবিক বন্যা

। শোকাতুর ঘটনায় আনন্দ কেড়ে নিয়েছে পাহাড়ের। অব্যাহত বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় মারা গেছে দেড় শতাধিক মানুষ। যা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে শোকবার্তা। অন্যদিকে চালের বাজার পুড়ছে দামের আগুনে। নিম্ন আয়ের মানুষজনের ঘরে হাহাকার। তিনবেলা ভাত খেয়ে যাদের অভ্যাস চালের দামের ঊর্ধ্বগতি তাদের গতিকেই থামিয়ে দিয়েছে হঠাৎ করে। এর ধাক্কা লেগেছে সর্বত্র। এ অবস্থায় এসেছে ঈদ। নিত্য সংসার চালাতে যাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের আবার ঈদ কিসের? তারপরও বছর শেষে আসা ঈদ বলে কথা।  নতুন পোশাক কেনা, ঘর গোছানো, নাড়ির টানে ঘরে ফেরা। সবকিছুই করতে হচ্ছে কষ্ট করে। তাই আসন্ন ঈদকে টানাটানির ঈদ আখ্যা দিয়েছে সাধারণ মানুষ। গতকাল বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ ও একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে তাদের মধ্যে এবারের ঈদে আনন্দের চেয়ে হতাশাই বেশি। নেত্রকোনার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর মিয়া। গত কয়েক মাস ধরে ঢাকায় রিকশা চালান। নেত্রকোনার হাওরে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে তার সারা বছরের খোরাক। কৃষি নির্ভর জাহাঙ্গীরের পরিবারে স্ত্রী-সন্তানসহ ছয় জনের সংসার। কিন্তু হাওর সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার পর চোখে দেখছিলেন গাঢ় অন্ধকার। কোনো উপায়ন্ত না পেয়ে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। এখন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়েই কষ্ট করে নিজে চলেন। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের জন্য টাকা পাঠান। জাহাঙ্গীর জানান, ঈদ আসছে। কিন্তু এবছর ঈদের কোন আনন্দ তিনি খোঁজে পাচ্ছেন না। প্রতি বছর ঈদ আসলে স্ত্রী সন্তানের জন্য ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার কাপড় কিনেন। এছাড়া আরো ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার অন্য বাজার কিনেন। কিন্তু এবছর পরিবারের জন্য কোনো কাপড় কিনতে পারবেন না। বাড়িতে ছেলে-মেয়েরা শুধু জিজ্ঞেস করছে কবে তাদের জন্য নতুন কাপড় নিয়ে যাবে। কিন্তু তিনি তখন চুপ করে থাকেন। কোন উপায় খোঁজে তিনি পাচ্ছেন না। কাপড় কিনলে অন্য বাজার করা হবে না। জাহাঙ্গীর জানান, এ বছরই বাচ্চাদের কোনো কাপড় না দিয়ে ঈদ করতে হবে। ধান চাষ করার সময় কিছু টাকা ধার করে এনেছিলাম। সেই টাকাও এখন পরিশোধ করছি না। পাওনাদাররা বাড়িতে এসে বসে থাকে।

ঢাকা ইডেন কলেজের ছাত্রী তানিয়া রহমান। বাড়ি সুনামগঞ্জের হাওর পাড়ে। কৃষিনির্ভর পরিবারে তানিয়ার জন্ম। তানিয়া জানান, তাদের এলাকার অধিকাংশ মানুষই কৃষি নির্ভর। ধান চাষ করে যে আয় হয় তা দিয়ে এলাকার মানুষের সারা বছর চলে। তানিয়া জানান, তার বাবাও একজন কৃষক। সারা বছর তাদের একমাত্র আয়ের উৎস ধান বিক্রি। তিনি গত ৫ বছর ধরে ঢাকায় লেখাপড়া করছেন। প্রতিবছর ঈদ আসলে বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো হয়। পরিবারের সবার জন্য কাপড় নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু এবছর কোন কাপড় কেনা হবেনা। কারণ ঋণে জর্জরিত বাবা এখন অনেকটা হতাশায় সময় পার করছেন। একদিকে ৫ জনের সংসারের যাবতীয় খরচ, ভাই বোনের লেখাপড়ার খরচ। সবমিলিয়ে এখন চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে তার পরিবার বাস করছেন। তানিয়া বলেন, তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর অবস্থাও একই রকম। ধার করা টাকা দিয়ে অনেকেই বুরো চাষ করে। ফলন হলে ধান বিক্রি করে আবার সেই টাকা ফেরত দিয়ে দেয়। কিন্তু এ বছর টাকা ফেরৎ দুরের কথা খেয়ে পরে বাঁচার কোন উপায় নেই। তাই এবছর তাদের এলাকায় কোনো ঈদের আনন্দ নাই।

কাওরান বাজার কাঁচাবাজারে সবজি বিক্রি করেন ময়মনসিংহের বাসিন্দা আলেয়া বেগম। বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সবজি কিনে ফুটপাতে বসে সবজি বিক্রি করা আয় দিয়ে সংসার চালাতে হয়। স্বামী কয়েক বছর ধরে কর্মহীন। দুই সন্তান তাকে সবজি বিক্রিতে সাহায্য করে। প্রতি বছর ঈদ আসলে সবাই মিলে বাড়িতে গিয়ে ঈদ করেন। নতুন কাপড় বাজার সদাই করে ঈদের একদিন আগে ঢাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু এ বছর তিনি বাড়ি যাবেন না। হাতে টাকা পয়সা নেই। যা আয় করেন সবই সংসারের খরচ চালাতে চলে যায়। জমানো কোন টাকা নাই। বাজারে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আগে চাল কিনতেন ৩২ টাকা দিয়ে। এখন চাল কিনতে লাগে ৪৬ টাকা। আলেয়া জানান, খরচ বেড়েছে, কিন্তু আয় বাড়েনি। শুধু চাল নয় বাজারের সব পণ্যই এখন বাড়তি দাম দিতে হয়। তাই এবছর আর ঈদ করা হবে না। বাচ্চারা আবদার করছে নতুন কাপড় দেয়ার জন্য। কিন্তু পারছেন না। ঈদের দিন সেমাই আর একটু মাংস খাওয়াতে পারবো কিনা জানি না। শুধু জাহাঙ্গীর, তানিয়ার পরিবার বা আলেয়ার সংসার নয়, এমন অনিশ্চিয়তায় দেশের হাজার হাজার পরিবারে। সেসব পরিবারে ঈদের কোনো আমেজ নেই। রাজধানীর মুদির ব্যবসায়ীরা জানান, এবছর তারা মরা সময় পার করছেন। কিছু হোটেল রেস্তোরাঁ আর কিছু ফ্যামিলি বাসার নিয়মিত ক্রেতারা আসছেন। সাধারণ মানুষের কোন আনাগোনা নাই। অন্য বছর এই সময়টা তারা অনেক ব্যস্ত সময় পার করেন। কিন্তু এ বছর ব্যস্ততা নেই। গতকাল বিভিন্ন বাজারের অনেক ব্যবসায়ীকে কর্মহীন সময় কাটাতে দেখা গেছে। বসে বসে ফেসবুক আর ইন্টারনেটে গান শুনছিলেন অনেক ব্যবসায়ী। কাওরান বাজারের আবদুল মান্নান নামের এক ব্যবসায়ী জনান, বিক্রি নাই, অলস সময় কাটাচ্ছি। ঈদের বাজার করতে তেমন কোনো ক্রেতা আসছেন না। দ্রব্যমূল্য কিছুটা বাড়তি থাকার কারণে কিছুদিন ধরেই ক্রেতা কম। ঈদ আসলে এমনিতেই বাড়তি ক্রেতা আসে। কিন্তু এবছর কি হলো কিছু বুঝলাম না। খোরশেদ আলম নামের চালের আড়ৎদার জানান, চালের দাম বেশী থাকার কারণে এখন চালের বাজার মন্দা। দামি চালতো দূরের কথা কম দামি চাল বিক্রি হচ্ছে না। হাওড়ে বন্যায় সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া ফুটপাতের অনেক কাপড় ব্যবসায়ী একই কথা বলছেন।  আনোয়ার হোসেন নামের এক কাপড় ব্যবসায়ী জানান, অন্য বছর এই সময় বিক্রি করে দম ফেলার সময় পাই না। কেউ কেউ একটার জায়গায় দুইটা তিনটা কাপড় কিনে নিয়েছেন। আর এই বছর ব্যবসা অনেক মন্দা। রিকশা চালক, ভ্যান চালক, গাড়িচালক, শ্রমিক, দিনমজুররা পোশাক কেনার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ঈদে সবাই কম-বেশি কাপড় কিনেন। কিন্তু এই ঈদে তেমন কোনো উল্লাস মানুষের মধ্যে নাই। তাদের জিজ্ঞেস করলে বলে, সংসার চালাতেই পারছি না, আবার ঈদ! এই ঈদ আনন্দের নয়, টানাটানির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *