শিক্ষা যখন চাকরিতে বাধা

Slider লাইফস্টাইল

69596_f11

 

 

 

 

 

 

ঢাকা: আসলাম আলম। রাজধানীর পরিবাগের একটি মেসে থাকেন। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। এখান থেকেই ২০০২ সালে এসএসসি এবং ২০০৪ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৪ সালে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেন। বাবা-মা নেই। ৫ ভাইয়ের মাঝে সবার ছোট আসলাম। মাস্টার্স পাস করার পর গত তিন বছরের মাঝে একটি এনজিওতে কিছু দিন কাজ করেছেন। এর আগে টিউশনি করে চলেছেন। এখন তিনি কিছুই করছেন না। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলছেন। বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির জন্য পড়াশোনা করেছেন। ইতিমধ্যেই বিসিএসসহ বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন। একই মেসে থাকেন আশিকুর রহমান। তিনি ২০১৩ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছেন। বিসিএসসহ বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু ডাক পাননি। চার বছর ধরে তিনি কর্মহীন। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বড় ভাইয়ের পাঠানো অর্থেই চলে তার মেসজীবন।
এরকম হাজারো শিক্ষিত কর্মহীন চাকরি পাচ্ছেন না। নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পাওয়ায় অনেকে স্বেচ্ছা বেকার জীবন বেছে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ নিচু পদে চাকরি নিয়ে টিকতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়া কেউ কেউ নিম্ন পদে চাকরি নিয়ে গ্রামে যেতে চান না। তাই তারা রাজধানীতে অবস্থান করে ভালো চাকরির আশায় সময় পার করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চাকরির জন্য উপযোগী শিক্ষা না পাওয়ার কারণে উচ্চ শিক্ষিতদের বেকারত্ব বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রম শক্তি জরিপ ২০১৫-১৬ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২ বছরে দেশে ১৪ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে, যা ৪.২ শতাংশ। তবে ২০১৩ সালের মতো এখন ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। অর্থাৎ বেকার সংখ্যা অপরিবর্তিত আছে। উচ্চ শিক্ষিতদের বেকারত্বের হার ৯ শতাংশ।  অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের তথ্যে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পরও নতুন কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৭ শতাংশ। সেটা ২০১০-১৫ সময়কালে কমে দাঁড়িয়েছে ১.৮ শতাংশে। তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান প্রায় স্থবির হয়ে আছে। বিশ্লেষকরা জানান, বাংলাদেশের শিল্প খাতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও কর্মসংস্থান কমেছে। এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণে জাতীয় সমন্বিত কর্মসংস্থান কর্মকৌশল গ্রহণ, প্রযুক্তি নির্ভর গুণগত শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। তাদের মতে, আবার এমনিতেই চাকরি কম হচ্ছে। এর মধ্যে যাদের বয়স ৩০-এর বেশি, তাদের চাকরি পেতে তুলনামূলক সমস্যা কম হয়। কিন্তু ১৫ থেকে ২৯ বছরের যারা, তাদের ব্যাপক প্রতিযোগিতায় পড়তে হচ্ছে। ফলে তরুণদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে বিবিএ ও এমবিএ করা শিক্ষিত শ্রমশক্তি আছে। কিন্তু সেগুলো কাজে লাগছে না। দেশে দক্ষ জনশক্তির বিপুল অভাব রয়েছে। শিল্প-কারখানায় ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তা দেশে একেবারে তৈরি হচ্ছে না। এজন্য এখন সময় এসেছে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে বাজারমুখী কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করার। এ ছাড়া শিল্প খাতে বিভিন্ন প্রণোদনা, কর অব্যাহতিসহ বিভিন্ন নীতিসহায়তা দিতে হবে।  সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। যেহেতু এর সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা জড়িত। অর্থনীতিতে যে ধরনের বৈচিত্র্যায়ণ দরকার, যার মাধ্যমে অধিক সংখ্যক মানুষকে কর্মসংস্থান দেয়া যাবে, সেখানে বড় ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে। এজন্য রপ্তানি বৈচিত্র্যায়ণ করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। দক্ষ শ্রমিক বাড়াতে হবে। রাজস্ব পলিসি, প্রণোদনা পলিসি, রেগুলেটরি পলিসি ও ডুয়িং বিজনেস কস্ট কমাতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হলেও কাঙ্ক্ষিত ও মানসম্মত কর্মসংস্থান হচ্ছে না বাংলাদেশে। তাছাড়া বিপুলসংখ্যক নারী রয়েছে শ্রমশক্তির বাইরে। মানসম্মত চাকরির অভাব রয়েছে। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ আর কর্মক্ষম পুরুষের ৩৫ শতাংশ কৃষিকাজ করে। বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক মনে করে, কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে ৫ ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো, কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, তরুণদের কর্মের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে অধিক প্রতিযোগিতা হ্রাস এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান গুটি কয়েক দেশে সীমাবদ্ধ না রেখে নতুন বাজার তৈরি। এদিকে বিবিএস নতুন শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ১৪ লাখ নতুন শ্রমশক্তি দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছে, কর্মসংস্থানও হয়েছে ১৪ লাখ। বেকারত্বের হার ৪.৩ থেকে কমে ৪.২ শতাংশ হয়েছে। এর পরও দেশে বেকারত্বের সংখ্যা ২৬ লাখ। এর মধ্যে ডিগ্রিধারী প্রতি ১০০ জনে ৯ জন বেকার; যা শতাংশের হিসাবে উচ্চ শিক্ষিতদের বেকারত্বের হার ৯ শতাংশ।
বেকারত্বের এই হিসাব আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দেয়া মানদণ্ড অনুযায়ী, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করতে পারেন না এমন বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ।
বিবিএস প্রতিবেদন মতে, কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ পাননি, এমন মানুষের মধ্যে মাত্র ২.২ শতাংশ বেকার। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীর মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি বেকার। জরিপ অনুযায়ী, এখন বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ। নারীদের বেকারত্বের হার ৬.৮ শতাংশ এবং পুরুষদের ৩ শতাংশ। নারী ও পুরুষ উভয়েই ১৩ লাখ করে বেকার।
উচ্চ শিক্ষিতদের মাঝে ১২.১ ভাগ বেকার। তাদের মধ্যে নারীদের হার বেশি, ১৫ শতাংশ। শহর অঞ্চলে বেকারত্বের হার (৪.৪%) গ্রামের তুলনায় (৪.১%) বেশি। দেশের কর্মক্ষম নারীদের ৬.৮ ভাগ বেকার, পুরুষদের মধ্যে ৩ শতাংশ বেকার।
বিবিএসের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৫ লাখ। এর আগের ২০১৩ সালের জরিপে এই সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ। এক দশকের ব্যবধানে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় সোয়া এক কোটি। ২০০৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, তখন দেশে ৪ কোটি ৭৪ লাখ কর্মজীবী মানুষ ছিলেন। ২০১০ সালে এসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৪১ লাখে। ওই সময়ে বছরে গড়ে ১৩ লাখ ৪০ হাজার বাড়তি কর্মসংস্থান হয়েছে।
দুই বছরের ব্যবধানে নারী ও পুরুষ উভয়ের গড় মজুরি বা আয় বেড়েছে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, পুরুষদের চেয়ে নারীরা কম আয় করেন। নারীদের গড় আয় ১২ হাজার ১০০ টাকা। ২০১৩ সালে আয় ছিল ১০ হাজার ৮১৭ টাকা। এখন একজন পুরুষ গড়ে ১৩ হাজার ১০০ টাকা আয় করেন, দুই বছর আগে ছিল ১১ হাজার ৭৩৩ টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *