রমজান এবং তাকওয়া, তাজকিয়া ও ইহসান

Slider শিক্ষা

8f46e5b7300fa8cac0c95362c4099cf4-592f1aa27cb4e

ঢাকা; তাকওয়া, তাজকিয়া ও ইহসান ইসলামি শরিয়তের সর্বোচ্চ তিনটি ধাপ। এগুলো শরিয়তের অভ্যন্তরীণ অংশ বা প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাকওয়া অর্থ সাবধান হওয়া, সতর্কতা অবলম্বন করা, ভয় করা, বেছে চলা, পরিহার করা, দূরে থাকা ইত্যাদি। পরিভাষায় তাকওয়া হলো, আল্লাহ ও রাসুল (সা.) কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াবলি থেকে দূরে থাকা। তাকওয়ার মূল কথা হলো আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সদা ভীত ও সতর্ক থাকা এবং নবীজি (সা.)-এর সুন্নত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর মহব্বত লাভের আশায় সদা সচেষ্ট, উদ্গ্রীব ও উৎকণ্ঠিত থাকা।
তাকওয়া ইসলামের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন প্রকৃত মোমিন তাকওয়া দ্বারাই পরিচালিত হন। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সত্কাজে অনুপ্রাণিত করে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সুরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘এই কোরআন তাকওয়াবানদের জন্যই হিদায়াত বা পথপ্রদর্শক।’ কোরআন করিমে বলা হয়েছে: ‘তোমরা যারা ইমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো।’ (সুরা-৩৩ [৯০] হজাব, রুকু: ৯/৬, আয়াত: ৭০, পারা: ওয়া মাইঁ ইয়াকনুত-২২, পৃষ্ঠা: ৪২৮/৬)। সুরা ইউনুস-এর ৬২ আয়াতে আছে, ‘যারা ইমান আনল এবং তাকওয়া লাভ করল, তারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তাও নেই।’ তাকওয়া মোমিন জীবনে এক অপরিহার্য অংশ, যা মানুষকে আত্মিক উন্নয়নের পথে পরিচালিত করে এবং নৈতিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করে।

রমজান মাস তাকওয়া অর্জনের মাস। তাকওয়া হিদায়াত লাভের পূর্বশর্ত। রমজান মাসের রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো এই তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে মোমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল, তাদের প্রতিও; যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (আল কোরআন, সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৩)।

তাজকিয়া অর্থ শুচিতা, পবিত্রতা, মানোন্নয়ন, শ্রীবৃদ্ধি ইত্যাদি। পরিভাষায় তাজকিয়া হলো আত্মশুদ্ধি, অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, আত্মিক উন্নতি, চারিত্রিক উৎকর্ষ ইত্যাদি। মূলত তাজকিয়া হলো, ষড়্‌রিপু তথা—কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাত্সর্যকে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা এবং মানব চরিত্রের নেতিবাচক গুণাবলি, যথা লালসা, অন্যায় বাসনা, পরনিন্দা, মিথ্যা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মপ্রচার, আত্ম-অহংকার, কার্পণ্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া। তাজকিয়া মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একজন মোমিনের প্রকৃত সাফল্য এই তাজকিয়ার ওপরই নির্ভর করে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সুরা আশ শামস-এর ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘প্রকৃত তারাই সফল হলো, যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করল।’ তাজকিয়া মোমিন জীবনে লক্ষ্য অর্জনের অনন্য পাথেয়, যা মানুষকে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

রমজান হলো তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধির জন্য অনুকূল ও সহায়ক। আর ওহি ও কিতাব নাজিলের উদ্দেশ্যও হলো তা-ই। হজরত ইবরাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন এই বলে: ‘হে আমাদের পরওয়ারদিগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনিই পরাক্রমশালী হিকমতওয়ালা। (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)।

এর উত্তরে মহান প্রভু জানান: ‘আল্লাহ ইমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন; তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও কাজের কথা শিক্ষা দেন।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৪)। মহান আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: ‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত।’ (সুরা-৬২ জুমুআ, আয়াত: ২)। ‘যেমন, আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসুল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণীসমূহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয়, যা কখনো তোমরা জানতে না।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫১)।

ইহসান অর্থ দয়া, করুণা, কৃপা, অনুগ্রহ ইত্যাদি। এর মূল উৎস হলো হুসন (সৌন্দর্য) বা হাসানা (কল্যাণ)। কোরআনে করিমের সুরা আর রহমানের ৬০ নম্বর আয়াতে আছে, ‘হাল জাজাউল ইহসান, ইল্লাল ইহসান’, অর্থাৎ ‘ইহসানের বিনিময় ইহসান ছাড়া আর কী হতে পারে?’ পরিভাষায় ইহসান হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের চরম শিখর ও পরম অবস্থা। হজরত উমর (রা.) বর্ণনা করেন, জিবরাইল (আ.) বললেন, হে প্রিয় নবী (সা.) ‘ইহসান’ কী? তিনি (সা.) বললেন, ‘ইহসান হলো এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, যেন তুমি তাঁকে দেখছ; যদি তা না হয়, তবে নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) তোমাকে দেখছেন।’ ইহসান হলো ইসলামি শরিয়তে বিধিবিধানের চূড়ান্ত লক্ষ্য। মোমিন জীবনের চরম সাফল্য ও পরম পাওয়া। এর মাধ্যমে বান্দার প্রতি আল্লাহর করুণার সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটে এবং বান্দাও আল্লাহর প্রতি সর্বতোভাবে অনুগৃহীত বোধে বিলীন হয়।

ইহসান অর্জনের উপায় কী? এ প্রসঙ্গে মুহাক্কিক আলেমগণ বলেন, উল্লিখিত হাদিসের মধ্যেই এর প্রচ্ছন্ন নির্দেশনা রয়েছে। তা হলো, (ফা ইন লাম তাকুন তারা হু) ‘যদি তুমি না হও, তবে তুমি দেখবে তাকে।’ অর্থাৎ আমিত্ব ও অহংকার বিসর্জন দেওয়া ও নফসের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়া ইহসান অর্জনের পূর্বশর্ত।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) জনসমক্ষে বসা ছিলেন, এমন সময় তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ইমান কী?’ তিনি (সা.) বললেন: ইমান হলো, আপনি বিশ্বাস করবেন আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, কিয়ামতের দিবসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রতি এবং তাঁর রাসুলের প্রতি। আপনি আরও বিশ্বাস রাখবেন মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি। আগন্তুক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইসলাম কী?’ তিনি বলেন: ইসলাম হলো, আপনি আল্লাহর ইবাদত করবেন এবং তাঁর সঙ্গে শরিক করবেন না, সালাত কায়েম করবেন, জাকাত প্রদান করবেন এবং রমজান মাসে রোজা পালন করবেন। ওই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইহসান কী?’ তিনি বললেন: আপনি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবেন, যেন আপনি তাঁকে দেখছেন, আর যদি আপনি তাঁকে না–ও দেখতে পান, তবে নিশ্চয় তিনি আপনাকে দেখছেন। (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮-৩৯, হাদিস: ৪৮)।

নিজের কাছে সৎ ও বিশ্বস্ত থাকা সবচেয়ে বড় অর্জন। এতে সহায়ক হলো ইহসান বা আল্লাহর অস্তিত্বের উপস্থিতির অনুভূতি। এটাই রমজানের শিক্ষা।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *