নিখোঁজের ৫ বছর: ফেরার আশায় পরিবার ও দল

Slider সারাদেশ সিলেট
 5fbe3eca48249d99f75caa50af50900a-58f3d35639495

.

সিলেট;  বিশ্বনাথের রামধানা গ্রামের আধপাকা একটি বাড়ি। বাড়িজুড়ে সুনসান নীরবতা। আঙিনায় কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর এলেন একজন। বললেন, ‘মাইজি (মা) তো কেউর লগে মাততা (কথা) চাইন না!’ বলেই বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। খানিক পর ঘরোয়া বেশে এলেন এক বৃদ্ধা। তিনি সূর্যবান বিবি (৭৫), বিএনপির ‘নিখোঁজ’ নেতা এম ইলিয়াস আলীর মা। জানা গেল, বছর পাঁচেক আগে এই দিনেই মাকে দেখতে এসেছিলেন ইলিয়াস আলী। খানিকক্ষণ থাকার পর মুঠোফোন বেজে ওঠে তাঁর। ‘মাইজি আইয়ার (আসছি)…’ বলে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যান। এক দিন পর বাড়িতে আসে তাঁর নিখোঁজ হওয়ার খবর।
সেই ছেলে ফেরার আশায় আজও একটু চিড় ধরেনি সূর্যবানের। তিনি বলেন, তাঁর মন বলছে ছেলে আছে, একদিন ঠিকই ফিরবে। ‘এক কালবৈশাখ ছেলেরে নিছে, আরও এক বৈশাখ আনি দিব…!’ ঘুরেফিরে এই কথাটিই বলছিলেন সূর্যবান।
নিখোঁজ হওয়ার সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পাশাপাশি সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন এম ইলিয়াস আলী। শুধু পরিবারই নয়, দলও ইলিয়াস আলীর ফেরার আশায় আছে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলী ও গাড়িচালক আনসার আলীর সন্ধানের দাবি নিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করছেন তাঁরা। পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন আজ সোমবার থেকে জেলা বিএনপি দুই দিনের কর্মসূচি পালন করবে। প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়ে পরদিন দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
২০১২ সালের এই দিনে ইলিয়াস আলী তাঁর গাড়িচালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর) আসনের সাংসদ ছিলেন ইলিয়াস আলী। কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, সরকারই তাঁকে ‘গুম’ করে রেখেছে।
পরিবার ও মামলার খোঁজে…
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় বনানীতে থাকেন। বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেন। স্বামীর অনুপস্থিতি তাহসিনাকে রাজনীতিসচেতন করেছে। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে আছেন তিনি। ইলিয়াসের নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগরে নিয়মিত আসা-যাওয়া রয়েছে তাঁর। পাশাপাশি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার। গতকাল রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ আসলে কোনো তদন্তই করেনি। প্রথম দুই-চার মাস আমি নিজে থেকে যোগাযোগ করেছিলাম, যদি কিছু হয়। কিন্তু এখন যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া মেলে না। তারা আসলে কোনো তদন্তই করেনি।’
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন তাঁর স্ত্রী। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে ইলিয়াসের খোঁজ চেয়ে রিটও করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত প্রতি মাসে পুলিশকে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিডি ধরে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। তবে নতুন করে বলার মতো কিছুই নেই। প্রতি মাসে হাইকোর্টে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ থাকায় দেশের প্রচলিত আইনে এখনো তাঁর ব্যাংক হিসাব বা অন্যান্য অস্থাবর সম্পদ বুঝে নিতে পারেনি তাঁর পরিবার। তাহসিনা জানান, ইলিয়াসের ব্যাংক হিসাবগুলো তাঁরা বুঝে নিতে পারেননি।
গাড়িচালকের পরিবারের কথা
ইলিয়াস আলীর সঙ্গে নিখোঁজ গাড়িচালক আনসার আলীর পরিবারেও দেখা গেল একই রকম ফেরার আশা। বিশ্বনাথে ইলিয়াস আলীর গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আনসার আলীর বাড়ি। মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতনে ইলিয়াস আলীর গাড়িচালকের চাকরি করতেন আনসার। ইলিয়াসকে ‘চাচা’ বলে ডাকতেন।
আনসারের মা নূরজাহান বেগম (৬০) জানান, ইলিয়াসের স্ত্রী এখনো প্রতি মাসে তাঁদের ৭ হাজার টাকা করে পাঠান। টানাপোড়েনের সংসারে ছেলের খোঁজ না পাওয়াটা তাঁদের জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্টের।
আনসারের স্ত্রী মুক্তা বেগমেরও বিশ্বাস তাঁরা দুজনই জীবিত আছেন, একদিন ফিরবেন। মেয়ে মারিয়া মাহজাবিনের (৮) কাছে বাবার কথা জানতে চাইলে এক বাক্যে বলে, ‘আব্বু ঢাকাত…!’ ‘মেয়েটাও অপেক্ষা করছে। কখনো কখনো অধৈর্য হয়ে আমার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে বাবাকে ফোন করার চেষ্টা করে। এ দৃশ্য দেখলে চোখে পানি চলে আসে,’ বললেন মুক্তা বেগম।
ইলিয়াস মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের মানববন্ধন
ইলিয়াস মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গতকাল সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে। এ সময় বক্তারা বলেন, সরকার জনগণের প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতেই পরিকল্পিতভাবে ইলিয়াস আলীকে ‘গুম’ করেছে। ইলিয়াস মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি শেখ মখন মিয়ার সভাপতিত্বে ও সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব এ টি এম ফয়েজ ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আজমল হোসেনের সঞ্চালনায় মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য দেন প্রবাসী বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান, সিলেট সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর দিনার খান প্রমুখ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *