বৈশাখী হুজুগের শিকার ইলিশ

Slider অর্থ ও বাণিজ্য গ্রাম বাংলা সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সারাদেশ

th

 

 

 

 

চৈত্র-বৈশাখের এ সময়ে স্রোতের টানে নদ-নদীতে ইলিশের বিচরণ বেড়ে যায়। ঠিক তখনই বৈশাখী হুজুগে এ দেশে মানুষের ইলিশ খাওয়ার ঝোঁকও বেড়ে যায়।

মৎস্য গবেষকেরা বলছেন, এই ঝোঁকের কবলে পড়ে এ সময় বাছবিচার না করে দেদার ধরা হয় ইলিশ আর এর বাচ্চা, যাকে বলা হয় ‘জাটকা’। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জাটকাগুলো মাত্র পাঁচ মাস বেঁচে থাকার সুযোগ পেলে পরিপূর্ণ ইলিশের পরিণত হতে পারত। আর বৈশাখের এই অতি ইলিশ ঝোঁকে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেও জেলেদের জাল থাকে শূন্য। তাই রসনাবিলাসী বাঙালির খাবারের থালা রয়ে যায় ইলিশশূন্য।

এক কেজি জাটকায় আট কেজি ইলিশ: গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার মাছের আড়তগুলোয় দুই দফা অভিযান চালান র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ও মৎস্য অধিদপ্তর। যেখান থেকে সাড়ে পাঁচ টন বা সাড়ে পাঁচ হাজার কেজি জাটকা জব্দ করা হয়। বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ এলাকায় থেকে অবৈধভাবে এই জাটকা ধরে ঢাকায় আনা হয়। জব্দ হওয়া জাটকা ৩০০ টাকা কেজির মূল্য ধরা হলে বাজারমূল্য ছিল সাড়ে ১৬ লাখ টাকা। অভিযানে জব্দ হওয়া প্রতিটির গড় ওজন ছিল প্রায় ৫০ গ্রামের কিছু বেশি। এই হিসেবে এক কেজিতে ২০টির মতো জাটকা পাওয়া গেছে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, অনুকূল আবহাওয়ায় মাত্র পাঁচ মাস সাগর-নদীতে থাকলে প্রতিটি জাটকার হতে পারত ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রামের ইলিশ। আট গুণ ওজন বৃদ্ধি পেলে এক কেজি জাটকা থেকে পাওয়া যেত আট কেজি ইলিশ। ৫০০ টাকা কেজি হিসেবে আট কেজি ইলিশের মূল্য দাঁড়ায় চার হাজার টাকা, অর্থাৎ এক টন ইলিশের দাম হতো প্রায় ৪৪ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে র‍্যাবের অভিযানে জব্দ হওয়া সাড়ে পাঁচ টন জাটকা এ বছর সেপ্টেম্বরে ইলিশে পরিণত হলে দাম হতো ২ কোটি ২০ লাখ টাকা।

র‍্যাবের নির্বাহী হাকিম সারওয়ার আলম  বলেন, ইলিশ এ দেশের জাতীয় সম্পদ। তবে জাটকা বিক্রি ও ধরা বন্ধ করতে সমন্বিত অভিযান প্রয়োজন। না হলে আড়তদারেরা জাটকা বিভিন্ন স্থানে সরিয়ে ফেলে গোপনে বিক্রিও করেন। জাটকা ধরায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা সব সময় নেওয়া হয়।

আট মাস জাটকা ধরা নিষেধ: ২৫ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চির নিচে ইলিশকে জাটকা বলা হয়। মৎস্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর নভেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত জাটকা ধরা, বিক্রি, মজুত ও পরিবহন নিষিদ্ধ।

এ ছাড়া দেশের ইলিশ অভয়াশ্রম এলাকায় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে মৎস্য অধিদপ্তর। মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে চাঁদপুর থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার, ভোলা জেলার মদনপুর থেকে মেঘনা নদীর শাহবাজপুরের ৯০ কিলোমিটার, ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া নদী ১০০ কিলোমিটার এবং শরীয়তপুরের নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জে পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ ও অন্য সব মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। একই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া থাকে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে আন্ধারমানিক নদের ৪০ কিলোমিটার এলাকায়।

দ্বিতীয়বার ইলিশকে ডিম পাড়ার সুযোগ: বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলা নদ-নদীর পানি ইলিশ মাছের ভীষণ প্রিয় বলে জানান মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মুস্তাফিজুর রহমান। তাঁর মতে, পানি, জোয়ার-ভাটা, খাদ্যের কারণে বছরজুড়ে এসব নদ-নদীতে ইলিশ বিচরণ করে থাকে। তবে ইলিশ যেন অবাধ বিচরণ করতে পারে, সে জন্য ছয়টি এলাকাকে ইলিশ অভয়াশ্রম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইলিশের খাবার প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পাওয়া যায়। এখানে পাওয়া যায় ছোট ছোট উদ্ভিদ ও পোকামাকড়। এসব খাবারই ইলিশ মাছ খেয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়ায় একটি ইলিশ দেড় বছরে পূর্ণ যৌবন পেয়ে যায়। দেড় বছরে একটি ইলিশের ওজন হয় প্রায় এক কেজি। এ ধরনের ইলিশের চর্বিযুক্ত আর খেতে সুস্বাদু হয়, যা পাওয়া যায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে। তাই ইলিশ উৎসব হবে ওই সময়। বৈশাখে বাচ্চা ইলিশ মেরে উৎসব করে তো লাভ নেই।

বাংলাদেশে ২০১৬ সালে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়েছে। এটি ইলিশ উৎপাদনে ভালো দিক বলে জানান এই মৎস্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘ইলিশ সাগর থেকে নদী এসে ডিম পাড়ে। এরপর ওই ইলিশ সাগর ঘুরে দ্বিতীয়বার নদীতে এসে ডিম ছাড়ার সুযোগ পায়, সেটি ভালো দিক। এর সুফল গত বছর আমরা পেয়েছি। ইলিশ উৎপাদন এবার অনেক বেড়েছে।’

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন। ইলিশ সংরক্ষণে পদক্ষেপের ফলে ২০১৬ সালে ইলিশ উৎপাদন হয় ৩ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন।

ইলিশ মাছ ধরে আয় করেন পাঁচ লাখ জেলে। তাঁদের আয়ের ওপর নির্ভর করেন ২৫ লাখ মানুষ। তাই জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে ইউএস এইড ও বিশ্বব্যাংকের সাহায্যে দুটি প্রকল্প নিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। প্রায় চার কোটি টাকায় একটি তহবিল গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই তহবিল পাওয়া গেলে জেলেদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হবে। মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জেলেদের জীবন পুরোটাই পরিবর্তন করতে চাই। জেলেদের যেন মহাজনের কাছে যেতে না হয়, সেই জন্য এই টাকা দেওয়া হবে। বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এলাকা চিহ্নিত করে এই ঋণ নিয়ে জেলেদের দেওয়া হবে। এই টাকায় নৌকা, জাল কিনে মাছ ধরবেন। নির্দিষ্ট সময় পর আবার টাকা ফেরত দেবেন। এতে জেলেদের কোনো সুদ দিতে হবে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *