মোঃ জাকারিয়া/ মোঃজসিম উদ্দিন/ আলী আজগর খান পিরু/ সামসুদ্দিন, গাজীপুর অফিস; মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯ মার্চ গাজীপুরে সংঘটিত হয়েছিল প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। যারা বলেছিলেন “জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর” তাদের সংগঠনে ছিলেন ১১জন। ২০১৭ সালে স্বশস্ত্র প্রতিরোধ দিবসে বড় অনুষ্ঠান হলেও আমন্ত্রন পাননি ওই সংগঠনের অনেক সংগ্রামী পরিবার।
এক পরিবারের সদস্য সংক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এবার রাজবাড়ি মাঠে গান হয়েছে, “যদি জানাজানি হয় ভালবাসা, তবে কি করে হবে মেলামেশা”। এই গানের সুফল আমরা পেয়েছি। আমাদের আমন্ত্রন জানানো হয় নি ভালবাসা জানাজানি হওয়ার ভয়ে। আমন্ত্রন না পাওয়ায় আমরা সকল পরিবার এক সাথে হতে পারিনি। ফলে গোপন ভালবাসা জানাজানি হয়ে গেছে, তাই মেলামেশাও হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে সংগ্রাম কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ১১জন। এর মধ্যে হাইকমান্ড কমিটির সদস্য ছিলেন ৩জন।
তারা হলেন, আহবায়ক মোঃ হাবিবুল্লাহ(বর্তমানে মৃত ও সাবেক এমপি এবং তৎকালিন আওয়ামীলীগ নেতা), সদস্য এম এ মোতালিব( তৎকালিন শ্রমিক নেতা বর্তমানে মৃত), সদস্য ডা: মনীন্দ্র নাথ গোস্বামী( তৎকালিন ন্যাপ নেতা)।
এ্যাকশন কমিটিতে আহবায়ক ছিলেন, এড. আ ক ম মোজাম্মেল হক(বর্তমান এমপি, মন্ত্রী ও তৎকালিন ছাত্র নেতা), সদস্য ছিলেন মোঃ নজরুল ইসলাম খান( তৎকালিন শ্রমিক নেতা ও বর্তমানে বিএনপি নেতা), শেখ মো; আবুল হোসাইন( তৎকালিন শ্রমিক নেতা ও বর্তমানে বিএনপি পন্থী নেতা), মোঃ আব্দুস সাত্তার মিয়া( তৎকালিন শ্রমিক নেতা ও বর্তমানে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রিয় নেতা), মোঃ নুরুল ইসলাম ভাওয়াল রতœ, মোঃ শহীদুল্লাহ বাচ্চু( তৎকালিন ছাত্র নেতা বর্তমানে মৃত), মোঃ শহীদুল ইসলাম পাঠান(তৎকালিন ছাত্র নেতা বর্তমানে মৃত), মোঃ হারুন অর রশিদ ভূঞা( তৎকালিন ছাত্র নেতা বর্তমানে মৃত)। এই দুটি কমিটিকে এক সাথে বলা হত, সর্বদলীয় ঐক্য কমিটি বা সর্বদলীয় স্বশস্ত্র সংগ্রাম পরিষদ।
বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর-১ আসনের এমপি এড. আ ক ম মোজাম্মেল হক ৭১ পরবর্তি সময়ে এক প্রত্যয়ন পত্রে ওই নামের তালিকা প্রকাশ করেন। অভিযোগ রয়েছে, ১৯মার্চে আরো যাদের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল অথচ কমিটিতে নাম ছিল না তাদের মধ্যে, কাজী আজিম উদ্দিন মাষ্টার(শিক্ষানুরাগী বর্তমানে মৃত), কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন( বর্তমানে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি), আব্দুর রউফ নয়ন( গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সহসভাপতি), সন্তোষ কুমার মল্লিক( বর্তমানে জীবিত ও ১৯ মার্চে গুলিবিদ্ধ), খন্দকার মোঃ হাছিবুর রহমান( যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা), ডাঃ মোঃ ইউসুফ( ১৯ মার্চে আহত), মোঃ শাহজাহান (১৯ মার্চে আহত), মরহুম মিজান উদ্দিন আহমেদ সহ অনেকে।
অনুসন্ধান সূত্র মতে, স্বাধীনতা উত্তর গাজীপুরে তেমনভাবে ১৯ মার্চ পালন করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে এই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় স্থানীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। প্রত্যেক অনুষ্ঠানে সংগ্রাম কমিটির সকল সদস্যের পরিবার সরকারী আমন্ত্রনও পেয়েছেন। কিন্তু ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুর রাজবাড়ি মাঠে কণ্ঠশিল্পী মমতাজ, বারী সিদ্দিকী ও ক্লোজআপ ওয়ান শিল্পী লিজার অংশ গ্রহনে অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গত সময়ের মত এবারই প্রথম সংগ্রাম কমিটির পরিবারগুলোকে সংবর্ধনা এমনকি আমন্ত্রনপত্রও দেয়া হয়নি। এই অবস্থায় সরকারী ব্যবস্থাপনায় গাজীপুর রাজবাড়ি মাঠে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে চলছে নানা কথা। অনুষ্ঠান শুরুর আগে মন্ত্রীর উপস্থিতিতে কতিপয় লোকের বাঁধাও আসে। স্থানীয় এমপি জাহিদ আহসান রাসেলের নাম ব্যানারে না থাকায় সৃষ্ট বাঁধায় অনুষ্ঠান বন্ধ থাকে প্রায় এক ঘন্টা। পরবর্তি সময়ে মন্ত্রী- এমপির মধ্যে আলোচনার পর বিলম্বে শুরু হয় অনুষ্ঠান।
এদিকে ১৯ মার্চ প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে প্রতিবছর আমন্ত্রন পেলেও এবার না পাওয়ার বিষয়ে হতাশা ব্যাক্ত করেন সংগ্রাম কমিটির পরিবার গুলো।
এ বিষয়ে স্বশস্ত্র সংগ্রাম কমিটির হাইকমান্ডের আহবায়ক সাবেক এমপি মরহুম হাবিবুল্লাহ’র স্ত্রী রোকেয়া হাবিব বলেন, প্রতিবছর আমন্ত্রন পাই। কিন্তু এবারই প্রথম আমন্ত্রনপত্র পাই নি।
সংগ্রাম কমিটির সদস্য মরহুম শহীদুল্লাহ বাচ্চুর ছেলে সাইফুল্লাহ শাওন জানান, তার পরিবার আমন্ত্রনপত্র পাননি। তিনি তার ফেইসবুক ওয়ালে আমন্ত্রন না পাওয়ার কারণে সংক্ষুদ্ধ হয়ে একাধিক স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। স্ট্যাটাস গুলোতে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিবেন না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একই ধরণের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মোঃ শহীদুল ইসলাম পাঠানের ছেলে মোঃ কামরুল ইসলাম পাঠান টিপুও। অনুরুপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে সংগ্রাম কমিটির অন্য অনেক পরিবার থেকেও।
এক পরিবারের সদস্য সংক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এবার রাজবাড়ি মাঠে গান হয়েছে, “যদি জানাজানি হয় ভালবাসা, তবে কি করে হবে মেলামেশা”। এই গানের সুফল আমরা পেয়েছি। আমাদের আমন্ত্রন জানানো হয় নি ভালবাসা জানাজানি হওয়ার ভয়ে। আমন্ত্রন না পাওয়ায় আমরা সকল পরিবার এক সাথে হতে পারিনি। ফলে গোপন ভালবাসা জানাজানি হয়ে গেছে, তাই মেলামেশাও হয়নি।
প্রসঙ্গত; ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে সংঘটিত হয় প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে শহীদ হন ৩ জন ও আহত হন একাধিক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯ মার্চকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। প্রতিবছর স্থানীয়ভাবে ১৯ মার্চ পালন হলেও সংগ্রাম কমিটির পরিবারকে সরকারীভাবে আমন্ত্রনপত্র দিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হত। এবারই প্রথম সংগ্রাম কমিটির সদস্য পরিবারকে আমন্ত্রন জানানো হয়নি।