ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ নজিরবিহীন

Slider ফুলজান বিবির বাংলা সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সারাদেশ

index

 

 

 

 

একাত্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী দেশজুড়ে বহু নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে। স্বাধীনতার মাসে আজকের পর্বে থাকল ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যার কথা
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরের আলো ফোটার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংস অভিযান শেষ হয়। ভোর পাঁচটায় সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান সেনানিবাসে তাঁর দপ্তরে চশমা পরিষ্কার করতে করতে বলেন, ‘না, কোথাও কোনো জনপ্রাণী নেই।’
টিক্কা খানের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক পরবর্তী সময়ে উইটনেস টু স্যারেন্ডার বইতে এ বর্ণনা দিয়েছেন।
২৬ মার্চ ভোরেই পরিস্থিতি বুঝতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জরিপ করতে বেরিয়েছিলেন মেজর সিদ্দিক সালিম। তাঁর বইয়ে ওই সকালের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলো জরিপ কর ছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিল। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা। কিন্তু কোনো অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিল না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম, বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো, অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
এই হলো পাকিস্তানি এক সেনা কর্মকর্তার নিজের দেওয়া বিবরণ। মেজর সিদ্দিক সালিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখছিলেন, আগের রাতে চলা একটি বিশেষ সামরিক অভিযান কতটা সফল হয়েছে সেটা সরেজমিনে দেখতে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ওই অভিযান চলেছে ২৫ মার্চ (দিবাগত) মধ্যরাত থেকে ২৬ মার্চ ভোর পর্যন্ত। এই অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মানুষ হত্যা।
অভিযানের প্রধান তিনটি লক্ষ্যবস্তুর একটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অপর দুটি লক্ষ্যবস্তু পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদর দপ্তর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযানটি কতটা নৃশংস ছিল, জগন্নাথ হলের ক্যানটিনের কর্মী সুনীল কুমার দাসের বিবরণে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। গত সোমবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সেদিন (জগন্নাথ হলের) শহীদ মিনারের পাশে কত লোকের যে লাশের সারি ছিল, তার কোনো হিসাব নেই। হল থেকে ছাত্রদের, হলের শিক্ষক-কর্মচারীদের হত্যা করে লাশ এনে কবর দেওয়া হয়। আমিসহ চারজন কর্মচারী একটা ড্রেনে লুকিয়ে ছিলাম। আমরা পরদিন সকালে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই।’
এই গণহত্যা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীর আর কোনো দেশে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারীদের গণহত্যার ঘটনার নজির নেই। ওই দিন রাতে পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হলে ঢুকে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়।’
সিদ্দিক সালিকের বই থেকেই জানা যায়, ওই অভিযানে ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগানসহ নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্র-শিক্ষক-কর্মীদের বিরুদ্ধে। মূলত গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তারপর বেশির ভাগ লাশ গণকবর দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক লাশ উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞটি হয়েছে জগন্নাথ হলে। এই গণহত্যার একটি ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নূরুল উলা। তিনি তখন বুয়েটের অধ্যাপকদের জন্য তৈরি চারতলা ভবনে থাকতেন, যেখান থেকে জগন্নাথ হলের ছাত্রাবাস আর মাঠ সরাসরি দেখা যেত।
রশীদ হায়দার সম্পাদিত ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বইটিতে নূরুল উলা লিখেছেন, ‘রাতে দেখি জগন্নাথ হল ছাত্রাবাসের চারপাশ পাকবাহিনীতে ছেয়ে গেছে। হলের কক্ষগুলোতে আগুন। কক্ষগুলোতে ঢুকে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সকালে উঠে দেখি মাঠের পশ্চিম দিকে লাশ এনে জড়ো করা হচ্ছে। আহতদের গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হচ্ছে। এভাবে কয়েকবার চলল।…আমি তাড়াতাড়ি ক্যামেরা সেট করে একটা কালো কাগজে ফুটো করে ক্যামেরার লেন্সটা জানালার কাচের ওপর রাখলাম। এরপরের তিনটা গণহত্যা ধারণ করলাম। বুলডোজার দিয়ে মাটি খুঁড়তেও দেখলাম।’
জগন্নাথ হলের তৎকালীন দারোয়ান সুনীল চন্দ্র দাসের স্ত্রী বকুল রানী দাস সে সময় কর্মচারীদের টিনশেডের বাসায় ছিলেন। গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত ১২টার দিকে হল-সংলগ্ন ইউওটিসির (বর্তমান বিএনসিসি) দেয়াল ভেঙে মিলিটারিদের সাঁজোয়া ট্যাংক হলের ভেতর ঢুকে পড়ে। এরপর শুধুই গুলির শব্দ। একপর্যায়ে এলাকার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয় হানাদারেরা। বাসার পুরুষদের ধরে নিয়ে যায় মাঠের দিকে। সেখানেই তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।’
জগন্নাথ হল-সংলগ্ন একটি বাড়িতে থাকতেন মধুর ক্যানটিনের মালিক মধুসূদন দে। তাঁকেও হত্যা করা হয়। তাঁর ছেলে অরুণ দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতভর গুলির শব্দ। জগন্নাথ হল থেকে আর্তচিৎকার। সকালে আমাদের বাসায় (সেনা সদস্যরা) এল। আমার দাদা আর নতুন বউদিকে বাসার ভেতরেই গুলি করে মারল। মা অন্তঃসত্ত্বা ছিল। মাকে প্রথমে কিছু করে নাই। বাবাকে গুলি করতে গেলে মা সামনে যায়। তখন বেয়নেট দিয়ে মায়ের হাত কেটে ফেলে। এরপর মাকে গুলি করে। বাবার গায়েও গুলি করে। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় বাবাকে নিয়ে আবার গুলি করে মারল।’
জগন্নাথ হলে সেদিন যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৬৬ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁদের নামের তালিকা উৎকীর্ণ আছে হলের মাঠে গণকবরের জায়গায় তৈরি একটি নামফলকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রতনলাল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা: ১৯৭১ জগন্নাথ হল বইতে বলা হয়েছে, ওই রাতে সেখানে গণহত্যার শিকার হন চারজন শিক্ষক, ৩৬ জন ছাত্র এবং ২১ জন কর্মচারী ও অতিথি।
গণহত্যার পরিধি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও হয়নি। এ নিয়ে বিশদ গবেষণাও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ১৯৫ জনের নাম আছে, যাঁদের পরিচয় পাওয়া যায়। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে আসা অনেককে হত্যা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আড়াই শ থেকে তিন শ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেসের সংলাপেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে।
১৯৭১ সালের গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছিলেন ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হলেই বাকিরা কাবু হয়ে যাবে। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। আর সে কারণেই ২৫ মার্চ রাতেই এখানে হামলা হয়। যেহেতু এটি পরিকল্পিত এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সুসজ্জিত হয়ে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নির্বিচারে হত্যা চালিয়েছে, কাজেই এটি গণহত্যা।’
ইকবাল হলে আক্রমণ
জগন্নাথ হলের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের ইকবাল হলেও (বর্তমান জহরুল হক হল) পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ ছাত্রনেতারা এই হলে থাকতেন বলেই অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিল এই হলটি।
রঙ্গলাল সেনসহ তিনজনের সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বইটিতে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ট্যাংক, জিপে বসানো রাইফেল, মর্টার, ভারী ও হালকা মেশিনগান নিয়ে জহুরুল হক হল আক্রমণ করে চারদিক থেকে। ছাত্রনেতা ও কর্মীরা হল ছেড়ে চলে গেলেও সাধারণ ছাত্র ও কর্মচারীরা হলে ছিল। জহুরুল হক হল আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাহারারত ইপিআর সৈনিকদের হত্যা করা হয়। এরপর ওই ভবনের ওপর সামনে ট্যাংক ও ওপরে কামান বসিয়ে জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলে গুলি করা হয়।
জহুরুল হক হলের মূল ভবনের সিঁড়িতে নিহত ছাত্র যাঁদের পরিচয় পাওয়া গেছে তাঁদের নয়জনের একটি তালিকা আছে। জহুরুল হলসংলগ্ন নীলক্ষেত আবাসিক এলাকায় তিনটি বাড়ির ছাদে আজিমপুর থেকে পালিয়ে আসা ইপিআর সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেও গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। ২৩ নম্বর ছাদ থেকেই শুধু ৩০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খুব কাছেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। ২৭ মার্চ সকালে শহর থেকে কারফিউ তুলে নেওয়ার পর সায়মন বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফরাসি আলোকচিত্রী মিশেল লরা। ২৫ মার্চ রাতের ধ্বংসযজ্ঞ তাঁরা প্রত্যক্ষ করেন শহরজুড়ে। ২০১২ সালের ২৩ মার্চ ঢাকায় প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে সায়মন ড্রিং বলেন, ২৭ মার্চ ঘুরতে ঘুরতে তিনি ইকবাল হলেও ঢুকেছিলেন। তিনি সেখানে নিজে ৩০টি লাশ গুনে দেখেছেন। ড্রিং জানান, সেদিন মর্টারের শেল আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিতে শুধু ইকবাল হলেই নিহত হয়েছিলেন ২০০ নিরপরাধ ছাত্র। হামলার দুই দিন পরও দেখা যাচ্ছিল পুড়ে যাওয়া রুমের মধ্যে পড়ে থাকা লাশ আর লাশ। পাকিস্তানি বাহিনী আরও বহু লাশ সরিয়ে ফেলেছিল আগেই।
রোকেয়া হলে হত্যা
২৫ মার্চ রাতে মেয়েদের আবাসিক হল রোকেয়া হলেও আক্রমণ হয়েছিল। কারণ, এই হলের মেয়েরা ডামি রাইফেল হাতে কুচকাওয়াজ করতেন। অবশ্য ওই হলের বেশির ভাগ মেয়ে আগেই হল ছেড়ে গিয়েছিলেন। অল্প কয়েকজন মেয়ে ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রোকেয়া হলে কী ঘটেছিল, সে ব্যাপারে ঢাকার সে সময়ের মার্কিন কনসাল জেনারেল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি প্রতিবেদন পাঠান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের একটি কক্ষে ছয়টি মেয়ের লাশ পা-বাঁধা ও নগ্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় হলের কর্মচারী আহমেদ আলী, আবদুল খালেক, নমি, মো. সোলায়মান খান, মো. নুরুল ইসলাম, মো. হাফিজুদ্দিন ও মো. চুন্নু মিয়াকে।
অন্যান্য হত্যাকাণ্ড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ঢুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেখানকার চার কর্মচারী, সলিমুল্লাহ হলে ঢুকে সেখানকার ১২ জন ছাত্র, ফজলুল হক হলের সাতজন, সূর্য সেন হলের সাতজন এবং মুহসীন হলের ১০ জন ছাত্রকে হত্যা করে। এর বাইরে ২৬ মার্চ সকালে গুরুদুয়ারা নানক শাহী, শিব ও কালীমন্দিরে ঢুকে সেখানকার পুরোহিতদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৭ মার্চ রমনা কালীমন্দিরে ২৭ জনকে হত্যা করা হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *