সাদিয়ার ফোনে ক্লাসনোটের ছবিই ছিল বেশি

Slider নারী ও শিশু ফুলজান বিবির বাংলা সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী

সাদিয়া হাসান (২২) ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষে পড়তেন। আট মাস পরই তিনি পাস করে বের হতেন। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বংশাল রোডে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেছেন। রাজশাহী থেকে মাকে সঙ্গে নিয়ে সারা রাত বাসভ্রমণ করে ঢাকায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন। বাস থেকে নেমে নিয়েছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা। কলেজের হোস্টেলে পৌঁছাতে তখন শুধু আর পাঁচ মিনিটের পথ বাকি। এ সময় একটি বাস এসে তাঁদের অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। মা ছিটকে পড়েন। আর মেয়ে অটোরিকশার ভেতরে আটকা পড়েন। সেখান থেকে উদ্ধার করে তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে সাদিয়া আর নেই। ওই দিন রাত ১০টায় রাজশাহী নগরের হড়গ্রাম গোরস্থানে সাদিয়াকে দাফন করা হয়।

সাদিয়া হাসানের বাড়ি রাজশাহী শহরের হড়গ্রাম এলাকায়। বাবা হাসানুজ্জামান পূবালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবে ২০০৮ সালে অবসর নিয়েছেন। মা শাহিন সুলতানা একজন কলেজশিক্ষক। দুই ভাইবোনের মধ্যে সাদিয়া ছোট। ভাই আবদুল্লাহ ইবনে হাসান এবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে হড়গ্রামে সাদিয়াদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল তাঁর মা শুয়ে আছেন বিছানায়। কথা বলার মতো অবস্থা নেই। সাদিয়ার বাবার সঙ্গে কথা হলো। তিনি বারবার মেয়ের ছোটবেলার স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছিলেন: ‘ছোটবেলা থেকেই মেয়ে পড়াশোনায় যেমন অসম্ভব ভালো ছিল, তেমনি নাচ-গানেও পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। শিশুশিল্পী হিসেবে দুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। রাজশাহী জেলা প্রশাসনের যেকোনো অনুষ্ঠানেই সাদিয়ার ডাক পড়ত।’

মায়ের সঙ্গে সেলফিতে সাদিয়াসাদিয়া হাসান রাজশাহী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় (হেলেনাবাদ) থেকে এসএসসি ও নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। দুটোতেই জিপিএ-৫ পেয়েছেন। বাড়ির আলমারি ভরে আছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাদিয়ার পাওয়া সনদপত্র আর মেডেলে।

সাদিয়া ভালো গান করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবার চাইল মেডিকেল কলেজে পড়াতে। হাসানুজ্জামান বললেন, ‘ও চিকিৎসক হবে। এতে মেধার স্বীকৃতিটা বেশি পাওয়া যাবে। সে-ও চিকিৎসক হিসেবে সমাজে বেশি অবদান রাখতে পারবে। দুর্ভাগ্যবশত সরকারি মেডিকেল কলেজে তার ভর্তির সুযোগ হলো না। তাই বেসরকারি মেডিকেল কলেজেই ভর্তি করে দেওয়া হলো। সেখানেও সে ভালো ফলাফল করেছে।’

সাদিয়ার ওয়ার্ড ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর গাইনোকলজি পরীক্ষা ছিল। বাবা জানালেন, ‘ওর মা ফোনে সকালে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন। বিকেলে আবার মাকে ফোন করত। মা-মেয়ে প্রায় ১৫-২০ মিনিট ধরে কথা বলত। রাতে ঘুমানোর আগে আবার মায়ের সঙ্গে কথা বলত। এ ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। বাড়ির প্রতি তার খুব টান ছিল। এক দিন ছুটি পেলেই রাজশাহী চলে আসত।’

২৩ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা দিয়েই রাজশাহীতে চলে এসেছিলেন সাদিয়া। আবার শনিবার সকালে পরীক্ষা ছিল। তাই শুক্রবার রাতেই তাঁকে যেতে হবে। রাত ১২টায় দেশ ট্রাভেলসের একটি বাসে তাঁকে তুলে দেওয়া হয়। রাতের কারণে মা-ও সঙ্গে গেলেন।

বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সবাই ধরাধরি করে সাদিয়ার মাকে বসার ঘরে নিয়ে এলেন। কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই কান্না চাপতে পারছেন না। একটু স্থিত হয়ে বললেন, ‘আমি ছিটকে পড়ে গেছি। উঠে দেখি মেয়ে সিএনজির ভেতরে আটকে রয়েছে। আমি তাকে বের করতে পারছি না। কিছুক্ষণ পরে পথচারীরা এসে টেনে বের করলেন। আমি আম্মু আম্মু বলে ডাকছি। আমার আম্মু আর কথা বলে না। তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। একজন পথচারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।’ কিন্তু জরুরি বিভাগে আগে টিকিট কাটতে হবে। শাহিন সুলতানা নিজেও আহত। একজন একটা টিকিট এনে দেন। সাদিয়ার মা বলতে থাকেন: ‘আমার বুকের মধ্যে ছটফট করে যাচ্ছে মেয়েটাকে সঙ্গে সঙ্গে আমি আইসিইউতে নিতে পারলাম না। ওর ফুফাতো বোন ফারিয়া মাহাবুবাও চিকিৎসক। ঢাকায় থাকে। ওকে ফোন করি। ও এল। এরপর যখন আইসিইউতে নেওয়া হলো, তখন সব শেষ।’ ডুকরে কেঁদে উঠলেন শাহিন সুলতানা, ‘আমি পাশে থেকেও মেয়ের জন্য ভালো চেষ্টা করতে পারলাম না। মেয়ের এত জাতীয় পুরস্কার দিয়ে আমি আজ আর কী করব?’

একটা ছবি দেওয়ার জন্য বড় ভাই আবদুল্লাহ সাদিয়ার মুঠোফোনটি নিয়ে এলেন, তাতে মাত্র দু-একটি ছবি পাওয়া গেল। ফোনজুড়ে শুধুই নোটের ছবি। বললেন, ‘হাতের কাছে বই না থাকলেও ফোন খুলেই পড়ত। সময় নষ্ট হবে বলে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেনি। বলেছিল, “ভাইয়া, পাস করে চিকিৎসক হয়ে তারপর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলব।”’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *