জলের গণতন্ত্রেই নদী ও পানির ভবিষ্যৎ

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি
16295802_376995669323538_1821167123_n
প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস প্রান্ত, বরিশাল বিভাগীয় ব্যুরোচীফ : জলের গণতন্ত্রেই নদী ও পানির ভবিষ্যৎ নিহিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পানির রাজনীতিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এই পরিস্থিতির উন্নতিতে নদীকে থাকতে দিতে হবে নদীর মতো। পানিকে তার প্রাকৃতিক সত্তায় চলতে দিতে হবে। আর এটি করতে হলে দরকার জনঅংশগ্রহণমূলক পানি ও নদী ব্যবস্থাপনা। তাই জলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতেই নদী ও পানির ভবিষ্যৎ নিহিত।
বুধবার পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় দুই দিনব্যাপী ‘জল ও জনতন্ত্র’ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পানি ও নদী বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। বক্তারা বলেন, নদী ও পানির অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশে এখনও জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়নি। আইনের সীমাবদ্ধতা, সাধারণ মানুষের চিন্তা ও মতামতকে কম গুরুত্ব দেয়ার কারণে এ পরিস্থিতি। ফলে দেশের ভেতরে পানির জন্য হাহাকার, দখল ও দূষণ। আঞ্চলিকভাবে পানি অধিকারবঞ্চিত বাংলাদেশ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘জল ও জনতন্ত্র’র ধারণাপত্র এবং সাম্প্রতিক একটি গবেষণার চিত্র তুলে ধরেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার শমসের আলী। এতে বলা হয়, পানির কৃত্রিম সংকটের ফলে নদী পাড়ের মানুষ তাদের জীবিকা হারাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। বৃদ্ধি পাচ্ছে লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি, মৎস্যসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে খারাপ উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। তার থেকে ভয়ংকর পরিস্থিতি হলো নদী মরে যাওয়া, মেরে ফেলা এবং পানির অধিকার ক্ষুণ্ন করা। সাধারণ মানুষের চিন্তা, মত ও উদ্যোগ যুক্ত না হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘নদীর অধিকার না থাকা মানে নদীকে মেরে ফেলা। ভোট দেয়ার মতো পানি পাবার অধিকার মানুষের রয়েছে। তাই পানি বিষয়ে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ খুবই গরুত্বপূর্ণ।’ নদীর পরিস্থিতির উন্নতিতে আমাদের দেশের রাজনীতি একটি বড় বিষয়। সেখানেই পানির অধিকার রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘বাংলাদেশে যত উন্নয়ন বা উন্নয়ন চিন্তা হয়েছে, তার পুরাটাই জমিকেন্দ্রিক।
16343610_376995469323558_1811967522_n
উন্নয়ন ভাবনায় পানি কিংবা নদীকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে নদী মরে যাচ্ছে, ভাঙছে, হারিয়ে যাচ্ছে। সমস্যায় পড়ছেন নদীপাড়ের মানুষ। প্রভাব পড়ছে গ্রাম থেকে শহরে। তবে দেশের ভেতরে বা আঞ্চলিক কারণে নদীর বিষয়ে সধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করা হয় না। যে আলোচনাটি হয় তা বিক্ষিপ্ত ও ধারণাপ্রসূত।’ img_20170125_120858অ্যাকশনএইড ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং বাংলাদেশে ‘মানুষ ও পানির অধিকার’ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। সেই গবেষণায়ও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নদীপাড়ের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, এদেশের পানি ও নদী নিয়ে সমস্যার মূল কারণ ভারত। এই ধারণার কারণ, দু’পাড়ের সাধারণ মানুষের কাছে নদী ও পানি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার পানির সুশাসন বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর শিক্ষক মেহেরুন্নেসা। তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় সরকার ও ভারতের দোষ দেই। কিন্তু নদী ও পানি পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সঠিকভাবে জানি না। নদীদূষণের জন্য আমরা কতটুকু দায়ী তা বুঝতে চাই না। তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’ নদীর জনতন্ত্র বিষয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে সঠিক তথ্য-উপাত্ত যদি উপস্থাপন করতে না পারি তাহলে নীতি-নির্ধারকদের কাছে গুরুত্ব পাওয়া যাবে না। সমস্যার সমাধান আসা উচিৎ প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকেই। কারণ তারাই নদী ও পানি নিয়ে সবচেয়ে বেশি জানে। যেহেতু আমাদের অনেক নীতির মধ্যে সমস্যা রয়েছে তাই স্থানীয়দের অভিজ্ঞতাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে স্থানান্তর করে উদ্যোগ নিতে হবে। পানির পরিমাণ সীমিত কিন্তু চাহিদা ক্রমবর্ধমান, পানির সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। নদী ভাঙন ও নদীর গতিপথ অনুযায়ী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অনেক জ্ঞান আছে। এই জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে’। পানির অধিকার নিয়ে কথা বলেন, নেপালের মহিলা অধিকার মঞ্চের উপদেষ্টা সাবিত্রি পোখারেল। তিনি বলেন, অধিকারের বিষয়টি খুবই গভীর একটি বিষয়। এর সঙ্গে প্রতিটি জীবন জড়িত। পানি ছাড়া বাঁচা যায় না এবং মরাও যায়না। সবাই মিলে কাজ না করলে পানি অধিকারের বিষয়ে আমরা সফল হব না। তাই তৃণমূল পর্যায় থেকে সংগঠিত হয়ে, দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃদেশীয় সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে। নদী নিয়ে আলোচনা করতে হালদা নদীর গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা এমন নদী যা বাংলাদেশে জন্ম বাংলাদেশেই শেষ। এ নদীকে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রষ্কা করতে হবে। দু’দিনব্যাপী এই আয়োজনের প্রথম দিন বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চারজন বিশেষজ্ঞ। যেখানে নদী ও পানির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। নদী ও পানির অধিকার রক্ষায় একটি সঠিক দিকনির্দেশনা তৈরি করাই এই সম্মেলনের প্রয়াস। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে পানির অধিকার রক্ষায় একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *