সিলেট প্রতিনিধি :: সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র থেকেও নেই। ভারপ্রাপ্ত মেয়রও নেই। সিটি করপোরেশন চলছে অনির্বাচিত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে। এর ফলে নগরের বাসিন্দারা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ছিলেন সিলেটের মাটি ও মানুষের প্রিয় নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। দ্বিতীয় বারও তিনি কারাগার থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বিএনপির নেতা আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১৩ সালের ১৫ জুন। ৪২ মাসের মধ্যে মাত্র ৯ মাস চেয়ারে বসতে পেরেছেন তিনি।
এরা দুইজনই ছিলেন জনগনের ভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধি। নাগরিক সেবা প্রদানে তারা ছিলেন সদা তৎপর।
সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এসএম কিবরিয়া হত্যা মামলায় আরিফুল হক চৌধুরী কারাগারে চলে গেলে সিলেট সিলেট সিটিকর্পোরেশন মেয়রহীন হয়ে পড়ে।
টানা ২ বছর ৪ দিন কারাগারে থাকার পর তিনি বের হলেও দায়িত্ব পাচ্ছেন না। কারণ, কারাবন্দী হওয়ার পরই তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
মেয়রবিহীন সিলেট সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও স্বস্তিতে নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কাউন্সিলর বলেন, তাঁরা জনপ্রতিনিধি, অথচ তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে অনির্বাচিত কর্মকর্তার অধীনে। এটা যে কত বড় অসম্মান, তা অন্যরা বুঝবেন না।
এ পরিস্থিতিতে নগরবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের অনুকূলে নয় বলে মনে করেন তাঁরা। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যে প্রতিষ্ঠানটি চালানোর কথা, সেটি না হওয়ায় একধরনের অস্বস্তি, চাপা ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
প্রতিশ্রুতি পালনের কাজ থেমে গেছে নগরবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে একটি হলো ফুটপাত দখলমুক্ত করে নগরের যানজট নিরসন করা। অপরটি জলাবদ্ধতা নিরসন। প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে পরিচিত নগর দিয়ে প্রবহমান নয়টি ছড়া (খাল) দখল-দূষণে বিপন্ন হওয়ায় প্রতিবছর বর্ষায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর এ দুটি অঙ্গীকারপূরণে কাজ শুরু হয়েছিল।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে টানা এক বছর ১৫ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার ফুটপাত দখলমুক্ত হয়। নয়টি ছড়া দখলমুক্ত করতে ধারাবাহিক অভিযানের পাশপাশি একই সঙ্গে চালানো হয় খননকাজ। এক বছরের মাথায় যানজট ও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতিও হয়েছিল।
কিন্তু ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে আরিফুল হক কারাগারে চলে গেলে দৃশ্যপট বদলে যায়। আরিফুলের নেতৃত্বে ফুটপাত দখলমুক্ত করার পর কেন্দ্রস্থলের মোড় কোর্ট পয়েন্ট থেকে সিটি পয়েন্ট পর্যন্ত যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘রিকশা লেন’। সেটি এখন নেই। ফুটপাত দখল আর দুঃসহ যানজট কোর্ট পয়েন্ট থেকে শুরু করে সিটি পয়েন্ট এখন আগের চেহারায়।
ছড়া খননকাজ চললেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলমুক্ত করার অভিযান বন্ধ হয়ে পড়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে মেয়রবিহীন সিটি করপোরেশন চলছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া স্থানীয় সরকারের এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানের পথচলা মোটেই সুখকর নয়। যে কাজ জনপ্রতিনিধির করার কথা, সেটা প্রশাসন বা আমলাদের নেতৃত্বে কতটুকু পূরণ করা সম্ভব, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, মেয়র কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দুই বছর ধরে নগরবাসী কোনো বাজেটও পাচ্ছে না। জবাবদিহির চর্চাও নেই। এ অবস্থায় করপোরেশনের আয়-ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কেও নগরবাসী ধারণা পাচ্ছে না।
নাগরিক সমস্যা ও ভোগান্তি সিলেটে দুটো ক্ষেত্রে বেশি দৃশ্যমান। একটি ফুটপাত বেদখল, অন্যটি জলাবদ্ধতা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, সিটি পয়েন্ট, প্রধান ডাকঘরের সম্মুখভাগ, জেল রোড, তালতলা, কিনব্রিজ এলাকা, সুরমা মার্কেট, আম্বরখানা, পাঠানটোলা, সুবিদবাজার, কদমতলী এলাকার ফুটপাতের প্রায় পুরো অংশই হকারদের দখলে রয়েছে।
দখল হয়ে পড়া ফুটপাতে শাকসবজি, ফলমূল, কাপড়চোপড়, জুতা, সিডি-ভিসিডি ও প্রসাধন সামগ্রীর বাজার বসেছে।
সিটি করপোরেশনের একজন প্রকৌশলী বলেন, নগরের ২৭টি ওয়ার্ডে নির্মাণাধীন ১৫ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার ফুটপাত হকারদের দখলে আছে। আবার ফুটপাত ছাড়াও মূল সড়কের আরও অন্তত দুই-তিন কিলোমিটার দখল করে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন।
দাড়িয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা সুবিমল দাশ বলেন, আরিফুল হক দায়িত্ব গ্রহণের পর রাতের বেলা বর্জ্য অপসারণ করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
এতে করে সকালে অফিস ও স্কুলমুখী লোকজনের ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ সহ্য করতে হতো না। এখন রাত গড়িয়ে দিনেও বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। ফলে উৎকট গন্ধে নগরবাসীকে নাকাল হতে হচ্ছে।
আরিফুল হক ২০১৪ সালে বাজেট পেশ অনুষ্ঠানে নয়টি ছড়ায় ১ হাজার ১০০টি ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা থাকার তথ্য তুলে ধরেছিলেন। এসব স্থাপনা উচ্ছেদ শুরুর আগে দখলদার পক্ষকে নিজে থেকে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তিনি।
আরিফুলের এ উদ্যোগ ‘ছড়া-অভিযান’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। নগরের উত্তরে চা-বাগানের টিলা এলাকা থেকে দক্ষিণে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়া গাভিয়ার খাল নামের একটি ছড়া দখলমুক্ত করার কাজ চালানোর সময় সেখানে একজন দখলদার ছড়ার দখল গুটিয়ে উল্টো ছড়ার জন্য জমি দান করেছিলেন।
নগরবাসী মনে এখন সিলেট সিটি করপোরেশন নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। মেয়র হীন সিলেট সিটি করপোরেশন আর কত দিন থাকবে।