বৃদ্ধাশ্রম থেকে পাঠানো এক মায়ের চিঠি

Slider গ্রাম বাংলা জাতীয় টপ নিউজ বাংলার মুখোমুখি সারাদেশ

image_2_441
ইজাজ আহমেদ মিলন
গ্রাম বাংলা ডেস্ক: বাবা রাসু, আমার বুকের ভেতর কেমন হুহু করে উঠছে! তুই কি ভালো নেই বাবা!তুই ভালো থাকবি বলেই তো বৃদ্ধাশ্রমের এই চার দেয়ালের মধ্যে আমাকে রেখে গেলি একদিন। তারপর আর কোন দিন তোর মায়াচ্ছন্ন মুখটা দেখিনি। এখনো রোজ ওই পথের দিকে চেয়ে থাকি। কেউ আসলে ভাবি এই বুঝি আমার ‘ তুই’ আসলি।সত্যি করে বল,তুই কি ভালো নেই? তুই যদি ভালোই থাকবি,তবে কেন আমার বুকের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হয় ? বিষাক্ত ধোঁয়া! চোখের জলে কেন ভিজে উঠে বালিশ!
তোর দাঁতের ব্যথা কি সারেনি বাবা!একদিন মধ্যরাতে হঠাৎ তোর দাঁতের ব্যথা উঠলো।তোর বয়স তখন তেরো পেরোয়নি।তোর ব্যথায় আমিও অঝোরে কেঁদেছিলাম । মাঝরাতে অনেকটা দিশেহারা হয়ে তোর বাবার কবরের পাশে গিয়ে বুক চাপড়িয়ে কাঁদছিলাম। বাড়িতে দুইটা টাকাও ছিল না যে ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ এনে দেবো তোকে।
মনে আছে রাসু- পরদিন পাশের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করে মায়না পেয়ে সন্ধ্যে বেলায় তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলাম। ওষুধ খেয়ে সেদিন তোর ব্যথা সেরেছিল। । আমি জানি এখনো সেই ব্যথা মাঝে মাঝে তোকে পীড়া দেয়।
শুনেছি বিদেশ গিয়ে দাঁতের চিকিৎসা করেছিস।কী ? ব্যথা সারেনি বাবা! গতরাতে স্বপ্নে দেখলাম- পুরনো সেই ব্যথায় তুই কাতরাচ্ছিস।আমি পাশের ঘরে বিভোর ঘুমে। তোর মেয়ে মানে রাইসা দরজা টকটক করে বলছে-‘ দাদু দাদু- আব্বু তোমাকে ডাকছে। তুমি ফু দিলেই নাকি আব্বুর দাঁতের ব্যথা সেরে যায়!
রাসু,
কার মুখের ফুয়ে তোর এখন দাঁতের ব্যথা কমে? দাঁতের ব্যথায় যখন তুই কাতর হয়ে যেতিহ, অসহ্য যন্ত্রণায় যখন গগন বিদারী কান্না করে বুক ভাইসাইতি তখন আমি তোর পাশে বসে আল্লাহকে ডাকতাম। পাগল হয়ে যেতাম । ব্যথা নিরাময়ে মানত করতাম। আমার পরণের ছেঁড়া শাড়ির আঁচল গরম করে তোর গালে ওম দিতাম। বিশ্রী গন্ধের শাড়িরর আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিতাম। কত বদলে গেছে সময় । তোর কি মনে আছে সেই সব কথা। খুব জানতে ইচ্ছে করছে। আজ খুব মনে পড়ছেরে বাবা তোকে। কেমন দম বন্ধ লাগছে।
বউ মা কেমন আছে? সেতেরো পেরোয়নি তোর এক বোনকে হারিয়ে আমি যখন পাগলপ্রায় তখন বউ মাকে কাছে পেয়ে আমার কলজের টুকরোটাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। গর্ভজাত আমার সেই মেয়ের মতোই দেখতাম বউ মাকে। আদর করতাম।মাঝে মাঝে কপালে চুমু খেতাম। প্রশান্তিতে বুকটা ভরে উঠতো।হালকা হতাম। বউ মা কি এগুলো পছন্দ করতো না?
আমার কী এমন অপরাধ ছিল বাবা! অতি আদরের বউ মা’র কাছ থেকে এতো দূরে সরিয়ে রাখলি? ওর মতো লক্ষী মেয়েই তো হয় না। দশগ্রাম খুঁজে তোর জন্য ওকে বউ করে এনেছিলাম।বউ মা কি এখনো ভোর বেলায় উঠে উঠোন পরিস্কার করে? থালা বাসন ঘষামাজা করে খুব সকালে রান্না শেষ করে ? নাকি কাজের মেয়ের ওপর নির্ভশীল হয়ে পড়েছে? বউ মাকে বলিস- পুরনো অভ্যাসটা যেন ধরে রাখে। শরীর ভালো থাকবে। তোর দাদি মাও আমাকে এমন শিক্ষাই দিয়েছিল। সারাক্ষণ আমার ঘরটা মাতিয়ে রাখতো তোর ছয় বছরের রাইসা। খুব ছোট বেলা থেকেই রাইসা আমাকে ছাড়া ঘুমাতো না। ওর শরীরের গন্ধ নাকে না আসলে আমিও ঘুমোতে পারতাম না। রাইসা ওর নানু বাড়ি গেলে বড় কষ্টে কাটতো আমার রাতগুলো। নির্ঘুম থাকতাম। তোর বাবাকে হারানোর পর রাইসাই আমার শয্যা সঙ্গী ছিল। আমাকে এক মুহূর্ত না দেখলে ও চিল্লাইয়া কাঁদতো। ও কি এখনো কাজু বাদামের জন্য বায়না ধরে? নাকি শপিংমলে নিয়ে য্ওায়ার জন্যে ? কতটুকুন বড় হয়েছে ও? আমার কথা কি মনে আছে রাইসার? আমার কথা কি ও কখনো জিজ্ঞেস করে না? কি বলিস তখন? রাইসাকে এক নজর দেখার জন্য আমি প্রায় সময় ছটফট করি। এ পাশ ও পাশ করি বিছানায় শুয়ে। তখন এই আশ্রমের ডাক্তার এসে আমার প্রেসার মাপে। পেট ব্যথা করছে কিনা- মাথা ব্যথা করছে নাকি জানতে চায়। আমি তখন নীরব থাকি। ডাক্তারের প্রশ্নে জবাব দেয় আমার চোখের জল।
বাবা রাসু,
তুই কি এখনো গভীর রাতে বাড়ি ফিরিস ? আমার খুব ভয় হয় বাবা ! চারদিকে তোর যে শত্রু, কে কখন কী করে ফেলে! ওরা তোর বাবারও শত্রু ছিল । দেখতে পারতো না তোর বাবাকে। এই সব দুশ্চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে থাকতাম। সর্তক করতাম প্রায় সময়। আমি জানি তোকেও ওরা মেনে নেয় না। চোখ কান একটু খোলা রেখে পথ চলিস।
পুতুল খেলার বয়স ফুরোনোর আগেই আমি বধূ হয়ে এসেছিলাম তোর বাবার কাছে। প্রায় চল্লিশ বছর সংসার করেছি। তারপর একদিন হঠাৎ তোর বাবা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো না ফেরার দেশে। বহুদিন হলো তোর বাবাকে স্বপ্নে দেখিনা। কাল শনিবার । তোর বাবার মৃত্যু দিবস। সুযোগ হলে দু’জন মিসকিন দাওয়াত করিস। বউ মাকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে বলবি। তোর বাবার আত্মা শান্তি পাবে।
রাসু,
এখানে আমার আর ভাল্লাগে না বাবা! ক’দিন আর বাঁচবো- আমি তো মৃত্যুর বয়সের কাছাকাছি। চোখে ঝাঁপসা দেখি। হাঁটা চলা করতে পারি না। কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে গেছে। রাসু,আমি আর আগের মতো খেতে পারি না। আধাপোয় চাল হলেই পুরো দিন চলে যায়। সাথে চেপা শূঁটকি ভর্তা হলে আর কিচ্ছু লাগে না। আমার কোন বাড়তি চাহিদা নেই। আগে পান খেতাম। ওটাও ছেড়ে দিয়েছি। তোর সংসারে কি আমার জন্য দিনে আধাপোয়া চালের জোগান হবে না?
শুনেছি, আমার হাতে গড়া ছোট্র সেই মাটির ঘরটা নেই এখন আর। তোর বাবার ভিটায় ছয়তলা বিল্ডিং করেছিস। দু’তলায় তোরা থাকিস। বাকিগুলো ভাড়া। তোর বাবা আদর করে একদিন এই ভিটা আমার নামেই লিখে দিয়েছিল। রাসু, এ দাবি আমি আর কখনো করবো না। কথা দিচ্ছি, কসম খেয়ে বলছি। তোর ওই বিল্ডিং এর কোন রুমে আমি উঠবো না। বাইরে একটা ছাপড়া করে দিস, ওখানেই থাকবো। একটুও দু:খ পাবো না। সকাল বিকাল তোকে দেখবো। গভীর রাতে তুই বাড়ি ফিরলে তোর পায়ের আওয়াজ শোনবো। সংসারে বউ মা’র ব্যস্ততা দেখবো। রাইসার স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য দেখবো। কিভাবে সাজুগুজো করে ও স্কুলে যায় – এই দৃশ্যটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে আমার ।
শুনেছি, তুই নাকি দামি গাড়ি কিনেছিস। বিশ্বাস কর, কথা দিচ্ছি, তোর ওই দামি গাড়িতে উঠে আমি ময়লা করবো না। ভয় পাসনে বাবা। আর যদি তোর বন্ধুরা বাড়িতে আসে আমি ছাপড়া থেকে বেরই হবো। যদি ওরা আমাকে দেখেই ফেলে তবে তাদেরকে বলবি- ওই মহিলা আমাদের বুয়া ছিল। বুড়ো হয়ে গেছে বলে এখানেই রেখে দিয়েছি।
রাসু,
আমার খুব ইচ্ছে করছে পরম দরদের ওই বাড়িতে একবার যেতে। অন্তত একবার আমাকে এসে নিয়ে যা। তোর বাবার কবরটা দেখিয়ে আবার এখানে রেখে যাবি। তোর বাবার কবরটা কি শ্বেতপাথরে বাধাই করেছিস ? মৃত্যুর আগে সে বলেছিল তার কবরটা যেন শ্বেতপাথরে বাধাই করে দেই। তখন তুই খুব ছোট ছিলি। আমার সাধ্যে কুলায়নি। কবরের ওপর কি সেই সবুজ ঘাসগুলো এখনো আছে। ঘাস ফড়িংগুলো কি এখনও উড়াউড়ি করে?
রাসু,
কত দিন হলো- তোকে নারকেলকুলি পিঠা বানিয়ে খাওয়াই না। নারকেলকুলি তোর খুব প্রিয় ছিল। বউ মাকে বলিস এবার শীতে যেন নারকেল কুলি বানিয়ে খাওয়ায় তোকে।
আমি জানি, তুই আর কখনো আমাকে নিতে আসবি না এখানে। আমাকে কি তোর একবারও মনে পড়ে না? আমার এই বিশ্রী অবয়বটা কি তুই দিব্যি ভুলে গেছিস ? আমি তোকে ভুলতে পারি না বাবা! আমি যদি মানুষ হতাম ভুলে যেতে পারতাম। যেমন ভুলে গেছিস তুই। আমি তোমানুষ নই। আমি একজন মা।
রাসু,
আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় কি সেই হাসনা হেনা গাছটা আছে ? ফুল ফুটে ? হাসনাহেনার গন্ধে পুরো বাড়ি মৌ মৌ করতো এক সময়। তোর খুব প্রিয় ছিল সে গন্ধ। ভর পূণির্মায় কি এখনো পুরো রাত তুই বাইরে কাটাস ?এখন কে সঙ্গ দেয় তোকে। এক সময় আমি তোর পাশে বসে থাকতাম।তোকে বাইরে রেখে আমি ঘুমোতে পারতাম না। চাঁদটা মেঘের আড়ালে চলে গেলে খুব ভয় হতো তোর। এখনোও কি ভয় পাস ? কে অভয় দেয় বাবা!
বাবা রাসু,
আমি জানি, আমার কাঁপা হাতের লেখা এই চিঠিটা পড়ে তোর খারাপ লাগবে। চোখের সামনে ভেসে উঠবে তোর সেই দু:সময়ের দিনগুলো। বিশ্বাস কর, তোকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমার এই লেখা নয়। তুই কষ্ট পেলে আমিও যে কষ্ট পাবো। তোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না।
তোর বাবা একদিন আমাকে বলেছিল – মৃত্যুর পরও যদি আমরা পাশাপাশি থাকতে পারতাম। কতই না ভালো হতো। আমারও অন্তিম ইচ্ছা তোর বাবার পাশে থাকার। আমার মৃত্যুর খবর পেলে আমার লাশটা নিয়ে তোর বাবার পাশেই রাখিস। এই অনুরোধটা অন্তত রাখিস বাবা। কাফনের কাপড় কেনা, মমবাতি আগর বাতি কেনা আর বৃদ্ধাশ্রম থেকে লাশ নেওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়ার কথা ভেবে আমাকে এখানে রাখিস না। আমার খুব অপ্রিয় এই বৃদ্ধাশ্রম।
আমার বিয়ের সময় তোর বাবা যে নাক ফুলটা দিয়েছিল , আমার কাছে সেটা এখনো আছে। তোর বাবার মৃত্যুর পর যখন অভারে আগুনে আমার সংসার দাউ দাউ করে জ্বলছে। তখনো এটা বিক্রি করিনি। তোর বাবার স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি। খাঁটি সোনায় বানানো নাকফুলটা সব সময় আঁচলে বেধে রাখি।এটা বিক্রি করলে আমার দাফনের খরচ হয়ে যাবে। এটা বিক্রি করে ফেলিস। আমাকে তোর বাবার কাছেই রাখিস! কথা দে রাখবি তো। আর রাইসাকে আমার চুমু দিস। ইতি তোর মা। –10534185_480067822096197_8435052840269259754_n

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *