ঢাকা; প্রেক্ষাপট একই। নির্যাতনের ধরনও প্রায় অভিন্ন। স্টিয়ারিংয়ে বর্মী সামরিক বাহিনী। ১৯৭৮ থেকে ২০১৬। মাঝখানে তিন যুগের বেশি সময় পেরিয়েছে। নাফ নদীর পানিও বেশ গড়িয়েছে। কিন্তু নিজ ভূমিতে নিগৃহীত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা আজও সেই তিমিরে। তাদের সংকট দিন দিন আরো ঘনীভূত হয়েছে। ৩৮ বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের হতদরিদ্র রোহিঙ্গারা দেশটির সামরিক বাহিনীর বর্বরতা থেকে প্রাণে বাঁচতে দলে দলে বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয়েছিল। পরবর্তীতে সীমান্তে মানবিক সংকট প্রকট হলে বাংলাদেশ তাদের অস্থায়ী আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। সেই সময়ে বার্মা ছিল পুরোপুরি অন্ধকারে। সামরিক জান্তার কবলে ছিল গোটা দেশ। দেশটির গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষীরা ছিলেন জেলে, না হয় আত্মগোপনে। এখন পরিস্থিতি বেশ বদল হয়েছে। গণতন্ত্রের আবহই শুধু নয়, পরবর্তী সময়ে বছরের পর বছর সামরিক জান্তার রোষানলে পড়ে কারান্তরীণ থাকা দেশটির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা অং সান সূচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। সামরিকতন্ত্রের বিপক্ষে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য নোবেল জয়ী নেত্রী সূচি এখন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর। দুনিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের যোগাযোগ বাড়ানোর দায়িত্বও তার কাঁধে। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। গণতন্ত্রের ওই মানসকন্যার উজ্জ্বল ভাবমূর্তি বিশ্বজোড়া। কিন্তু এই একটি ইস্যু- রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন প্রশ্নে তার সেই অর্জন, নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নেয়ার দাবি উঠেছে! তার আমলে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা চলছে। তা-ও পুরনো কায়দায়। দেশটির সামরিক বাহিনীর ক্র্যাকডাউন বা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ৭৮’ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যে মানবিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই সময়ে বাংলাদেশের ওপর অন্যায়ভাবে যে কূটনৈতিক চাপ তৈরি করা হয়েছিল, ফের সেদিকেই কি হাঁটছে মিয়ানমার- এ প্রশ্ন ঢাকার বোদ্ধাজনদের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য সেই চাপ সামলে ওঠার আগাম কৌশল নিয়েছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, বিশেষ করে এর উৎসমূল রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট হত্যাযজ্ঞ এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মানবিক সংকটের বিষয়ে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এখানে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠনের প্রতিনিধিদের ডেকে পুরো পরিস্থিতি অবহিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সেই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশের মিশনগুলোকেও ওই সব দেশের সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর হেড কোয়ার্টারকে ব্রিফ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সত্তরের দশকের বার্মা আর আজকের মিয়ানমারের মধ্যে মিল-অমিল খোঁজার চেষ্টা করছেন। সামরিক জান্তার সেই আমলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব তদন্তের নামে অভিযান চালিয়েছিল বর্মী সেনারা। এখন সেখানে ফৌজিদের অভিযান চলছে জঙ্গি ধরার নামে। সেই সময়ে নাগরিকত্বের কাগজ দেখাতে না পারার কারণে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। নাগরিকত্বের ডকুমেন্ট আজও জোটেনি তাদের। মিয়ানমার সরকার এখনও দেশটির নাগরিক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। তার ওপর জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ততার দায়! সব মিলেই সাঁড়াশি অভিযান চলছে রাখাইনজুড়ে। এই ক্রেকডাউনে প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন। ফলে আন্তর্জাতিক ওই সীমান্ত এখন রীতিমতো অস্থিতিশীল। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, অত্যন্ত মানবিক কারণে কিছু রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছে বাংলাদেশ। মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে এই মানবিক আচরণ করছে। শুরুর দিকে সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন অনড় অবস্থানে থাকলেও এখন মানবিকতাকে ঊর্ধ্বে রাখতে গিয়ে খানিকটা নমনীয়। বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, সরকারের মানবিকতার ওই সুযোগে এরই মধ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতির উৎসস্থল অর্থাৎ রাখাইন রাজ্যে শান্তি বা স্থিতিশীলতা ফেরার আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় (ঢাকা-নেপিড আলোচনা) কোনো উদ্যোগ এখনও কার্যকর হয়নি। যদিও বাংলাদেশের তরফে প্রতিনিয়তই দেশটির সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ‘৭৮ সালে রোহিঙ্গা নিয়ে দেশটির নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় সফলতা পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সময়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশে সেই সংখ্যা এখন ৫ লাখের বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারো বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজছে। ঢাকা আশাবাদী দেশটির নবপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দেবে। বিশেষ করে দেশটির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী আন সং সূচি। তার দিকে চেয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নেতৃত্ব। গণতন্ত্র ও শান্তির জন্য লড়াইকারী নেত্রী অং সান সূচি এখনো রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খোলেননি!