সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অবস্থান শাঁখের করাতের মতো

Slider টপ নিউজ

40922_rana

 

ঢাকা; রাষ্ট্র বদলায়। সরকার বদলায়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হামলার চিত্রের তেমন বদল হয় না। কেন বন্ধ হয় না এই ধরনের হামলা? এর নেপথ্যে দুটি কারণ স্পষ্ট বলা যায়-১. সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি তা থেকে রাষ্ট্র এখনও বের হতে পারেনি। ২. প্রশাসনের একটি অংশ যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামপ্রদায়িক হামলায় যুক্ত তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যশোরের মালোপাড়া থেকে বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলা দুঃখজনক হলেও সত্য প্রতিক্রিয়াশীল হামলাকারী চক্রের সঙ্গে সরকারিদলের একাংশের মেলবন্ধন রয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ে দেখা গেছে জয়-পরাজয়ে উভয় পক্ষই হামলা চালায় সংখ্যালঘুদের ওপর। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অবস্থান শাঁখের করাতের মতো। সামপ্রতিক সময়ে একের পর এক হামলার ঘটনায় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের আস্থাহীনতা বাড়ছে বলেও মনে করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। নাসিরনগর, গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সামপ্রদায়িক সহিংসতা পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরেন তিনি।
প্রশ্ন-কক্সবাজারের রামু, যশোরের মালোপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর-একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা। কীভাবে দেখছেন?
২০১২ থেকে এ পর্যন্ত আমরা যতগুলো ঘটনা দেখেছি। যেটা পাবনার সাঁথিয়া থেকে, সাতক্ষীরা, কক্সবাজারের রামু, যশোরের মালোপাড়ায় এবং সবশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যে হামলা দেখেছি তা প্রায় একই ধরনের। সেখানে মন্দির, উপাসনালয়, বিগ্রহ ভাঙচুর হয়েছে, বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে, দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে, লুট হয়েছে, মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণকে সংখ্যালঘু বিতাড়নের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এটা আমার কাছে অনেকটা একাত্তরের মতোই মনে হয়। একেক সময় একেক জায়গায় এ  ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হামলার শিকার হচ্ছে। যেখানে আছে কামার, জেলে, তাঁতিসহ নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত। বলে রাখা দরকার, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সামপ্রদায়িক হামলা ও আক্রান্তের শিকার হয়েছে মূলত শহরের জমিদার শ্রেণি, উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা ছিলেন তারা মূলত পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী। তারা ক্ষমতা দখল করে যে নীতিটি গ্রহণ করে তা হলো- সংখ্যালঘু নিধন প্রক্রিয়া। বঞ্চনা বৈষম্য নিপীড়নকে সেদিনের রাষ্ট্রীয় শক্তি সংখ্যালঘু সমপ্রদায়কে নির্যাতনের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সম্পত্তি কল-কারখানা কেড়ে নেয়ার জন্য শত্রুসম্পত্তি আইনের মতো একটি বৈষম্যমূলক আইনকে তারা বেআইনিভাবে চালু রেখেছিল। পাকিস্তানি গোষ্ঠীর আরেকটি লক্ষ্য ছিল, সংখ্যালঘু জনগণকে বিতাড়ন করে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগুরু জনগণকে সংখ্যালঘিষ্টে পরিণত করা এবং ঔপনিবেশিক কায়দায় তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন ও শোষণ করা।
লক্ষ্য করার মতো বিষয়, ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৬ অর্থাৎ বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে কখনও দাঙ্গা  হয়নি। দাঙ্গা হয় সমানে-সমানে। দঙ্গা কখনও সমানে-অসমানে হয় না। পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী  আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে একতরফা সামপ্রদায়িক সহিংসতা চালানো হয়েছে। তখন ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আর পূর্ব বাংলার গভর্নর মোনায়েম খান। সে সময়ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত একতরফা সামপ্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে বর্ষীয়ান রাজনীতিক আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান নাগরিক সমাজকে নিয়ে সামপ্রদায়িকতা প্রতিরোধে কমিটি গঠন করেছেন। সে সময় ঢাকায় এক প্রতিবেশী হিন্দুকে রক্ষা করতে গিয়ে আমীর হোসেন নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছিলেন। ফাদার নোবাকের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার  নির্যাতন আর শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল সর্বস্তরের বাংলা ভাষাভাষী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত মুক্তি সংগ্রাম। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন তিনিও তার ঘোষণায় বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতার যে ইশতেহার ঘোষিত হয়েছিল সেখানেও বলা হয়েছে বাংলাদেশ হবে সকল নাগরিকের। সাম্য, সমতা, সমমর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে সেই ইশতেহারে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২-এ রচিত হলো ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সংবিধান।
১৯৭৫-৭৭ এই সময়কালে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশ পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করে। তিনি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। সংবিধানকে সামপ্রদায়িকীকরণ করলেন। ধর্মের নামে রাজনীতির অনুমতি দিলেন। সেই সুযোগ নিয়ে একাত্তরে পরাজিত শক্তি আবারও মাঠে নামে। এরই পথ ধরে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করলেন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ফিরলেও জিয়া-এরশাদের প্রেতাত্মা থেকে সংবিধান আজও মুক্ত হয়নি। বিদ্যমান এ সংবিধানে বাংলাদেশও আছে, পাকিস্তানও আছে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতাও আছে, ধর্মতন্ত্রও আছে। এটা স্পষ্টত বলতে চাই, বিদ্যমান সংবিধান সামপ্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের পাহারাদার।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যা ঘটছে- তা কিভাবে দেখছেন?
১৯৭৫-এ যারা ক্ষমতায় এলেন তারা আবার পাক শাসকদের অনুসৃত নীতি সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়াকে তাদের নীতি হিসেবে গ্রহণ করলেন। রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে সকল বঞ্চনা-বৈষম্য-নিগ্রহ-নিপীড়ন আবার শুরু হলো। এর আওতায় আমরা দেখি ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী  আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য রাষ্ট্রীয়পর্যায় থেকে একতরফা সামপ্রদায়িক সহিংসতা চালানো হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামে। তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে এরশাদের পতন হলেও এরপর যারা ক্ষমতায় এলেন তারা কেউই রূপরেখার ধার দিয়েও গেলেন না। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের বাবরি মসজিদ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সাতাশ দিন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় একতরফা সামপ্রদায়িক সহিংসতা চালানো হয় রাষ্ট্রীয়পর্যায় থেকে। জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ক্ষমতায় তখন ২০০৬ পর্যন্ত একতরফাভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সামপ্রদায়িক সহিংসতা চলে বিক্ষিপ্তভাবে। ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ জোট ক্ষমতায় তখনও দেখা গেল ২০১২ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত একতরফা সামপ্রদায়িক সহিংসতা চালানো হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিগত এই ছয় বছরে সামপ্রদায়িক হামলার পেছনে আসলে কারা?
আমরা লক্ষ্য করছি রাষ্ট্রীয়ক্ষমতায় না থাকা সত্ত্বেও একাত্তরের পরাজিত শক্তি বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু শূন্য  করে প্রকৃত অর্থে তাদের দৃষ্টিতে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য এবং শরিয়া আইন চালুর জন্য, বাংলাদেশের বৈচিত্র্যের সংস্কৃতিকে হারিয়ে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়াকে এরাই এগিয়ে নিতে চায়। যা তারা অতীতে বিএনপি জোট আমলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এসব প্রতিক্রিয়াশীল হামলা চক্রের সঙ্গে আমরা সরকারিদলের একাংশের মেলবন্দনকে প্রত্যক্ষ করছি। মূলত এদের লক্ষ্যটা হচ্ছে ব্যক্তিক। এরা লুটপাট, সম্পদ আহরণ, ভূমিদখল করতে চায় এবং ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে এরা তাদের আমানত হিসেবে দেখতে চায়। ধারণাটি এমন যে, থাকলে ভোটটি আমার, চলে গেলে জমিটা আমার।
সামপ্রতিক ইউপি নির্বাচনে লক্ষণীয় যে, বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচন বর্জনের ফলে প্রায় জায়গায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। সেখানেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অবস্থান হচ্ছে শাঁখের করাতের মতো। আওয়ামী লীগ জয়ী হলে বিদ্রোহী আওয়ামী লীগাররা হামলা চালায় আর বিদ্রোহী আওয়ামী লীগার জয়ী হলে আওয়ামী লীগাররা হামলা চালায়।
প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে যদি এ অবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে এখনও যে নয় থেকে দশ ভাগ সংখ্যালঘু এদেশে বাস করছে তা শূন্য হতে আর ক’বছর লাগবে? দেশটি যদি সংখ্যালঘু শূন্য হয়ে যায় তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎটি কেমন দাঁড়াবে? উপমহাদেশীয় পরিস্থিতিইবা কেমন দাঁড়াবে? আর মুক্তিযুদ্ধের যে বাংলাদেশটিকে গড়ার জন্য আমরা স্বপ্ন দেখছি সেই স্বপ্নের বাংলাদেশটিই কেমন দাঁড়াবে?
প্রশ্ন : বর্তমান সরকারকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং অসাম্প্রদায়িক সরকার। কিন্তু এই সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক আক্রমণ হচ্ছে। এর কারণ কি?
কারণ হলো- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার থাকা অবস্থায়ও এই সরকারের আমলে একের পর এক হামলার ঘটনায় এটা স্পষ্ট সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি তা থেকে রাষ্ট্র এখনও বের হতে পারেনি। প্রশাসনের মধ্যকার একটি অংশ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর যে আন্তরিক সদিচ্ছা সেটির বাস্তবায়নে বাধা। কারণ তারা সামপ্রদায়িক মানসিকতায় আচ্ছন্ন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপে দৃশ্যমান তারা। বর্তমান সরকারি দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে সামপ্রদায়িক হামলাকারীদের পক্ষে অবস্থান করছে।
প্রশ্ন : বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা, মন্দির, বসতবাড়ি ভাঙচুড় ও নির্যাতনের ঘটনার পর আপনি দেশের নানা প্রান্তে গিয়েছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রকৃত অবস্থা কি দেখেছেন?
সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে আজও কোনো প্রশ্ন নেই। তবে তারা আশাহীন ও আস্থাহীন হয়ে পড়ছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের অগণতান্ত্রিক আচরণের মধ্য দিয়ে।
সৌজন্যে মানবজমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *