নাসিরনগরের সহিংসতা ও আওয়ামীলীগের অসাম্প্রদায়িক গুনকীর্ত্তন  

Slider ফুলজান বিবির বাংলা
8e7a020f3dfe983283642bb4282c2f6c-untitled-3
প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস প্রান্ত : নাসিরনগরের সহিংসতা একাত্তরের আর এক খন্ড চিত্র এমন কথা এখন সবার মুখে মুখে।ঘটনার প্রথম দিকে বিষয়টিকে অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত করে বলা হচ্ছে বলে অনেক পন্ডিত প্রতিবাদ তুলতে দ্বিধান্বিত না হলেও বর্তমানে তাদের চৈতন্য ফিরেছে।প্রথমদিকে হিন্দুধর্মীয় কিছু সংগঠন কে মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল করতে দেখা গেলেও অন্যকোন সংগঠনকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। কিন্তু মিডিয়ায় ফলাও করে সত্যপ্রচারের ফলে বিদেশীদের কাছে বিষয়টি পৌঁছে গেলে সরকারের বোল পাল্টে যেতে দেখা যায়। আর এ সুযোগে মুক্ত চিন্তার শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোও তাঁদের মনের কথা বলার প্রয়াস পাওয়ায় যেমনটি তাঁদের বিবেকের দংশনটা প্রশমিত হয়েছে তেমনটি হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভীতিটাও কিছুটা কমে এসেছে। কারো মুখে এখন আর শোনা যায়না এটা কোন ঘটনাই নয়, এরকম হতেই পারে ইত্যাদি অসংলগ্ন ভাষন। মাথামোটা যে লোকগুলো উস্কানি দিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটনার পথ বাতলে দিয়েছিল তারা এখন প্রশাসনের চাপে চুপচাপ থাকলেও ঘরবাড়ী হারানো নি:স্ব নাসিরনগরের হিন্দুরা যে যেকোন সময়ে আকস্মিক হামলার সম্মুখীন হতে পারে এ বিষয়টি কিন্তু মোটেও উপেক্ষার নয়। এইতো গত বৃহস্পতিবার রাতেও নাসিরনগরে ফের হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা।এটা কিভাবে সম্ভব? এতবড় সহিংসতা ঘটে যাওয়ার পর আবারো এর পূনরাবৃত্তি হল এটাকে কিভাবে নিবেন অসাম্প্রদায়িক নেতাগন, একবার জানতে ইচ্ছে হয়। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা থাকলে এটা আদৌ সম্ভব হত কি? স্থানীয় সাধারণ জনগন, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন বলছে, নাসিরনগর উপজেলা সদরের মধ্যপাড়ার অমর দেবের রান্নাঘর, দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা ফুলকিশোরের গরু রাখার ঘর, মৃণাল কান্তির রান্নাঘর ও জ্বালানি কাঠ রাখার ঘরসহ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কিভাবে পূনরাবৃত্তি ঘটিয়ে সহিংসতা চালানো হল এর উত্তর কারো কাছে আছে কী? রোববার ১৫টি মন্দির ও কমপক্ষে হিন্দুদের ৬০-৭০টি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হল উল্লাস করতে করতে। ভিডিও চিত্রও রয়েছে অথচ মন্ত্রী ছায়েদুল নির্দ্বিধায় বলে দিলেন, ‘সব স্বাভাবিক।’ বাহ! মন্ত্রীর সত্যবাদিতার তুলনা হয়না। এর পরপরই যশোরে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটল এবং হবিগঞ্জের মাধবকুণ্ডে মন্দিরে সহিংস হামলার ঘটনা ঘটে গেল, ঝালকাঠিতে মন্দির ভাঙা হল।এ দৃশ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে দাবী করা আওয়ামীলীগ সরকার কিভাবে দেখছেন, এটাই প্রশ্ন। রবিবার হামলা হল অথচ পুরো চার দিন অতিবাহিত হবার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর আসনের সাংসদ ছায়েদুল হক এলেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে। তিনি যেসব কথা শুনালেন, তাতে আক্রান্ত মানুষগুলো ভরসা না পেয়ে হতাশার সাগরেই ডুবলেন। আশ্বস্ত হওয়া দূরের কথা বরং বেদনাহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন মন্ত্রীর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রতি। প্রশ্ন এসে যায় তাহলে কি মাননীয় মন্ত্রীর ইন্ধনে পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই হামলার নীল নকশা আঁকা হয়েছিল? আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটি সুসম্পন্ন হওয়ার পর মন্ত্রী নিশ্চিন্ত হয়ে কি বক্তব্য দিবেন সেই পূর্বপ্রস্তুতকৃত বক্তব্যটিও এসে সব হারানো মানুষগুলিকে শুনিয়ে তাদের বুঝিয়ে দিলেন তোমরা দেশ ছেড়ে যাও। আমার মনে হল এদেশের কোন দলই অসাম্প্রদায়িক নয়।মুখে অসাম্প্রদায়িকতার শ্লোগান দিলেও এরা আসলে সাম্প্রদায়িকতাকেই লালন করে চলেছে।ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করায় লতিফ সিদ্দিকীর দলীয় ও সংসদীয় পদ গেলেও হিন্দুধর্ম নিয়ে কটুক্তি করা ছায়েদুল হক এর বিষয়ে এ পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। কাজেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যে থেকেই যাচ্ছে এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।এইতো সেদিন তোপখানা রোডে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ হিন্দুধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ মিছিল মানব বন্ধন হয়ে গেল। ২০০১ সাল থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর অনেক হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু বিক্ষোভে ফেটে পড়া এ রকম মিছিল কখনো হয়েছে বলে মনে পড়েনা। মিছিলকারীরা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে এবং তাঁর নাম ধরে শ্লোগান দিয়েছেন। নাসিরনগর ডাকবাংলোতে গিয়ে ওই মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘নাসিরনগরের পরিবেশ সাংবাদিকেরাই অস্বাভাবিক করে তুলেছেন। নাসিরনগরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক, আপনারা অস্বাভাবিক করে তুলেছেন। আমি সার্বক্ষণিক এলাকার সব খোঁজখবর রাখছি।’ (সমকাল, ৩ নভেম্বর ২০১৬)। কাজেই তিনি যে খোঁজ খবর রেখেছেন এটা স্পস্ট।তিনি স্থানীয় হিন্দু নেতাদের অশালীন ভাষায় গালাগাল করেছেন যা নাসিরনগরের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের মাধ্যমে জানা যায়। যেখানে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে আক্রমণ করা হয়েছে, সেখানে স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী কী করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সান্ত্বনা না দিয়ে সেই সম্প্রদায়ের নেতাদের গালাগাল করেন? তা–ও ‘সংখ্যালঘু বিদ্বেষী’ অশোভন বাক্যে।বিএনপি বা জামায়াতের কোনো মন্ত্রী নন, সংখ্যালঘুদের ত্রাণকর্তা বলে দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী।জানা যায় ‘মন্ত্রী মহোদয় বদলি হয়ে যাওয়া ওসিকে স্থানীয় পাঁচজন সংখ্যালঘু নেতাকে গ্রেপ্তার করতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওসি বলেছেন, “আমি তো বদলি হয়ে গিয়েছি।”’ কাজেই প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়া প্রয়োজন। সত্যি সত্যি মন্ত্রী এ রকম কথা বলেছিলেন কিনা এবং বললে সে মোতাবেক যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া ও জরুরী বলে মনে করি।বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে যা জানা যায়, তা হলো ২৮ অক্টোবর জনৈক রসরাজ দাসের ফেসবুকে একটি অবমাননাকর পোস্ট দেওয়া হলে স্থানীয় মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ২৪ ঘণ্টা ধরে মাইকিং করে রোববার কলেজ মোড়ে ও আশুতোষ মাঠে দুটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। কলেজ মোড়ের সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হলেও মাঠের সমাবেশ থেকে উসকানিমূলক কথা বলা হয়, যার আয়োজক ছিলেন নাসিরনগর উপজেলা কমপ্লেক্স জামে মসজিদের ইমাম এবং উপজেলা কওমি ওলামা পরিষদের সহসভাপতি মোখলেছুর রহমান। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের অভিযোগ, শনিবার রসরাজ দাসকে গ্রেপ্তারের পরও নাসিরনগরের ইউএনও পরদিন রোববার দুটি সমাবেশ করার অনুমতি দেন, যা পরিস্থিতি খারাপ করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে জেলা নেতৃত্ব, আরেক দিকে মন্ত্রী ছায়েদুল হক। এক বিতর্কিত ব্যক্তিকে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ায় জেলা নেতৃত্ব মন্ত্রীকে দল থেকে বহিষ্কার করে, যদিও তা কেন্দ্র অনুমোদন করেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা বিরল। সুতরাং আওয়ামীলীগ যে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িত হয়ে গিয়েছিল এটা সূর্যালোকের মতই স্পস্ট বলেই ভেবে নেওয়া যেতে পারে।
নাসিরনগরের সহিংসতার পেছনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল যে দায়ী, সেটি মন্ত্রী গোপন রাখেননি। বৃহস্পতিবারের সমাবেশে তিনি আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে বলেছেন, ওরাই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। আওয়ামী লীগের কে কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, সেটি জনগণের দেখার বিষয় নয়। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রকে কেন্দ্র করে কেন হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হবে, কেন মন্দিরে হামলা হবে? দায় এড়াতে পারেন না ওসি ও ইউএনও। তাঁরা বিশৃঙ্খলার আশঙ্কাকে আমলে না নিয়ে দুই পক্ষকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছেন এবং একটি সমাবেশে গিয়ে বক্তৃতাও দিয়েছেন। ওসি বা ইউএনওর কাজ সমাবেশে বক্তৃতা করা নয়; বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা। ওসি বদলি হলেও ইউএনও বহাল তবিয়তে আছেন! কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হোসেনের লেখা থেকে কিছু অংশ যোগ করছি। ” ২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর একই অজুহাত তুলে কক্সবাজারের রামুসহ কয়েকটি এলাকায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে আক্রমণ চালিয়ে কয়েক শ স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। সরকার সেসব বাড়িঘর ও বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করে দিলেও আক্রমণকারী কাউকে শাস্তি দিতে পারেনি। সেবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বৌদ্ধ সম্প্রদায়, এবার হিন্দু সম্প্রদায়। ফেসবুকের পোস্ট অছিলা মাত্র। ব্যক্তিগতভাবে কেউ অপরাধ করলে গোটা সম্প্রদায় সে জন্য দায়ী হতে পারে না। রামুর ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে উত্তম কুমার নিজে ওই কাজ করেননি, তাঁর ফেসবুক ব্যবহার করে অন্য কেউ করেছেন। রসরাজও বলেছেন, তিনি ধর্ম অবমাননাকর কোনো পোস্ট দেননি। তাঁকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর, লুট এবং মন্দিরের প্রতিমা ভাঙার কী কারণ থাকতে পারে? মন্দিরে হামলা কি ধর্ম অবমাননা নয়? প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দিরে হামলা এবং হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বড় অংশই কিশোর-তরুণ। শার্ট-প্যান্ট পরা এসব যুবক উপজেলার গোকর্ণ, পূর্বভাগ, চাপড়তলা, ভলাকুট, চাতলপাড়, গোয়ালনগর, বুড়িশ্বর, দাঁতমণ্ডল, ফান্দাউক, হরিপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিল। এদের একটি অংশ সমাবেশে যোগ না দিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটে অংশ নেয়। আরেকটি অংশ সমাবেশ থেকেও হামলায় অংশ নেয়। তাহলে স্থানীয় প্রশাসন ও থানা-পুলিশ কী করেছে? তাদের কাজ কি বসে বসে তামাশা দেখা? স্থানীয় হিন্দুদের অভিযোগ, চাপড়তলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে সেদিন আশুতোষ মাঠের সমাবেশে যোগ দেয়। সেখানে সুরুজ আলী উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ বলছে, বাইরে থেকে লোক পাঠানোর পেছনে সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নানের ভূমিকা ছিল। জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিপরীত মেরুতে থাকলেও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করার ব্যাপারে এক। রামুতেও একই ঘটনা ঘটেছিল। নাসিরনগরের ঘটনা তদন্তে আসা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য এনামুল হক চৌধুরী ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পরিদর্শন করে বলেছেন, ‘একাত্তরে যেভাবে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, নাসিরনগরের ঘটনার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। এখানে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। কেন, কী কারণে এখানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হলো?’ প্রকৃত ঘটনা বের করতে হলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। কিন্তু বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হলে কিংবা তারা যথাযথ রিপোর্ট দিলেই যে অপরাধীরা শাস্তি পাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ২০০১–এর নির্বাচনের পর সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও নৃশংসতা চালিয়েছিল, সেটিকে অনেকটা পুঁজি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার একটি কমিশনও গঠন করেছিল, যার রিপোর্ট কয়েক বছর আগেই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে মামলা কিংবা শাস্তি হওয়ার খবর পাওয়া যায় না। শাস্তি পায়নি রামু বা সাঁথিয়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার দোহাই দিয়ে যারা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালিয়েছিল, তারাও। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, আক্রমণকারীরা বহিরাগত। স্থানীয় কেউ হামলা করেনি। এ তথ্য যদি সঠিকও ধরে নিই, স্থানীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা কী করেছেন? তাঁরা কেন নিরাপত্তা দিতে পারলেন না? কেউ কেউ দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তা কাজে আসেনি। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকারের ইন্ধনে ঢাকায় দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল এবং সেই দাঙ্গা রুখতে আমির হোসেন চৌধুরী নামের একজন মুসলমান দাঙ্গাকারীদের রুখতে গিয়ে তাদের হাতে জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু, আরও বেশিসংখ্যক মানুষ কেন প্রতিরোধে এগিয়ে আসবেন না? ২০০১-এর নির্বাচনের পর ঢাকার অদূরে শ্রীপুরে আক্রান্তকবলিত এক গ্রামে গেলে সংখ্যালঘু পরিবারের নারীরা বলেছিলেন, ‘বাবা, ভোটার তালিকা থেকে আমাদের নামটি বাদ দাও। তাহলে ভোটের কারণে কেউ আমাদের ঘরবাড়িতে হামলা চালাবে না।’ বাংলাদেশকে শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ বলে আমরা বড়াই করি। কিন্তু সেই শান্তি ও সম্প্রীতি যারা ভঙ্গ করে, যারা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে, যারা ভিন্ন ধর্মের মানুষের ঘরবাড়ি লুট করে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিবাদ দেখি না। আমাদের প্রশাসন খুবই দায়িত্বশীল। রাজনীতিকেরা পরমতসহিষ্ণুতার জ্বলন্ত প্রতীক। আমাদের নাগরিক সমাজ মানবাধিকারের বলিষ্ঠ খেদমতগার। এসবের পরও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে। তাহলে গলদটি কোথায়? ঐক্য পরিষদের এক নেতা অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে বললেন, এই যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নাম করে হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ করা হলো, মন্দিরে হামলা হলো, সেটি ধর্ম অবমাননা নয়? কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে নিয়ত আঘাত করা হচ্ছে। কই, তারা তো কখনো কারও ওপর হামলা চালায় না। এমন কোনো মাস নেই যে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হয় না। প্রতিমা ভাঙচুর হয় না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর সারা দেশে সংঘটিত তাণ্ডবের পর লেখক-গবেষক মোহাম্মদ রফি লিখেছিলেন, ‘ক্যান উই গেট অ্যালং?’ আমরা কি এভাবে চলতে পারব? একই দেশে শত শত বছর পাশাপাশি থেকেও কেন একটি সম্প্রদায় আরেকটি সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে আক্রমণ করে? এর পেছনে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক কারণটাই বা কী?
সময় টিভি নিউজ থেকে উল্লেখ করছি, “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগরের ঘটনা । পবিত্র কাবা শরীফকে নিয়ে রসরাজ এর নামে যেই মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে ৩০০ হিন্দু ঘর, ১৫ এর অধিক মন্দিরের প্রতিমা এবং ৬ টি হিন্দু ঘর পোড়ান হয়েছিল, প্রকৃত পক্ষে তার আসল অপরাধী হলেন ওই এলাকার হরিপুর ইউনিয়ন এর সভাপতি ফারুক মিয়া। গত ইলেকশনে ওনাকে ভোট না দেবার কারনে, রসরাজকে ফাঁসানোর জন্য এই কাজ করেছেন ফারুক মিয়া। রসরাজ দাস পেশায় একজন জেলে। একজন জেলে ফেজবুক সম্পর্কে কতটুকু দক্ষ হতে পারে? তদন্ত করার পর জানা যায়, ফারুক মিয়া রসরাজ দাস কে ফাঁসানোর জন্য রসরাজের নামে ফেজবুক আইডি খুলে এবং সেই আইডি থেকে কাবা শরীফকে অবমাননা করে একটি ছবি পোস্ট দেয় এবং পরে ফারুক মিয়া তার চাচাতো ভাই কাপ্তান মিয়াকে দিয়ে স্থানীয় মুসলিমদের ক্ষেপীয়ে তুলেন। সাংবাদিকদের কাছে এই কথা নিজ মুখে স্বীকারও করেছেন কাপ্তান মিয়া। এই হল অবস্থা!!! ক্ষমতা পাবার লোভে নিজের ধর্মকে নিজেরাই বিকৃত করে অন্য ধর্মের মানুষের উপর দোষ চাপিয়ে দিল ফারুক মিয়া ও তার দলবল। মাঝখান দিয়ে অত্যাচারের স্বীকার হল নাছিরনগরের ৩০০টি হিন্দু পরিবার। ভেঙ্গে গেল অনেক উপাসনালয়। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে অনেক হিন্দুর বাসস্থান। বাংলাদেশ যে অসাপ্রদায়িক দেশ তার থেকে বিশ্বাস হারালো লাখো হিন্দু বাঙ্গালী। ৬ টি হিন্দু পরিবার এখনও নিখোঁজ আর কিছু বলার ভাষা নেই। জাতি এখন কি বলবে? যা ফাটার তা তো হিন্দুদেরই ফেটেছে। পরিশেষে এই মিথ্যা নাটকের মধ্য দিয়ে হিন্দুরা পেল ৭১’এর সেই উপাধিঃ মালাউন”
পরিশেষে রানা দাশ গুপ্তের ভাষায় বলতে হয়, হিন্দুরা এমন এক জাতি যাদের আত্মসম্মান বোধ পৃথিবীর যেকোন জাতির চেয়ে বেশি। হিন্দুরা ৭১ থেকে শুরু করে বারবার সর্বহারা হয়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। কারো কাছে ভিক্ষার জন্য যায়নি, তারা ভিক্ষা দিতে জানে কিন্তু ভিক্ষারীর মত হাত পাততে জানেনা। এদেশ স্বাধীনের জন্য হিন্দুরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, কাজেই এ দেশের প্রতি তাদের জন্মগত অধিকার, এদেশ ইসলামি রাষ্ট্র হতে দেওয়া যাবেনা।এদেশে সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। সকল হিন্দু এখন থেকে সেই প্রতিবাদী মন নিয়ে আগামীর পথ চলবে। কোন অবস্থায় এ দেশ ত্যাগ করা যাবেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *