ঢাকা; ঘূর্ণিঝড় নাদার প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল। ছবিটি গতকাল পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে তোলা : আখতার হোসাইন
ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’ ধেয়ে আসার খবরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার পাশাপাশি আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিম্নচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে ৯০ জেলেসহ অন্তত ২০টি ফিশিং ট্রলার ডুবে গেছে। তিন জেলে নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে বিপুলসংখ্যক লাইটার জাহাজ, কয়েক শ’ ফিশিং ট্রলার ও মাছ ধরার নৌকা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় চট্টগ্রামে নামতে পারেনি ২টি আন্তর্জাতিক ফাইট। ঘূর্ণিঝড় সতর্কতায় চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টানা ভারী বর্ষণে জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’ ধেয়ে আসার খবরে য়তি এড়াতে গতকাল দুপুরের পর থেকেই দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের পণ্য ওঠানামায় বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য লাইটারিং বন্ধ হয়ে গেছে। বিমানবন্দর কর্তৃপ সতর্কাবস্থায় থাকলেও ফাইট অপারেশন বন্ধ করার পরিস্থিতি হবে না বলে আশা করছে। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আন্তর্জাতিক রুটের ২টি বিমান চট্টগ্রামে নামতে পারেনি। নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে বিপুলসংখ্যক লাইটার জাহাজসহ কয়েক শ’ ফিশিং ট্রলার ও মাছ ধরার নৌকা। উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের মাছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’র প্রভাবে গতকাল বঙ্গোপসাগর ছিল উত্তাল। বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছিল নগরীর বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে। সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস ৪১.৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। দিনভর বাতাসের তীব্রতা তেমন না থাকলেও সন্ধ্যা থেকে মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল।
য়তি এড়াতে প্রস্তুতি শুরু : চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কতা হিসেবে বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিং বন্ধ জেটি ও মুরিং বয়ায় নোঙররত সমুদ্রগামী জাহাজগুলোকে স্বাভাবিকের দ্বিগুণ রশি দিয়ে জেটি থেকে নিরাপদ দূরত্বে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বন্দরের সব উদ্ধার জাহাজকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন জেটি ও ইয়ার্ডের মূল্যবান অপারেশনাল ইকুইপমেন্ট লক করে প্যাকিং করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়। জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে রায় ইয়ার্ডে রতি পণ্যভর্তি কনটেইনার নিচে খালি কনটেইনারের ওপর লিফট করে এবং বিভিন্ন সিএফএস শেডে রতি মালামাল যতদূর সম্ভব সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
লাইটারেজ জাহাজ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিটিসি) নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, পণ্যবাহী ও খালি জাহাজ মিলে প্রায় ২০০ লাইটার জাহাজকে কর্ণফুলী নদীতে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার মোহাম্মদ রিয়াজুল কবির নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে পুরো বিমানবন্দর। ঘূর্ণিঝড়ে বিমানবন্দরের অপারেশনাল কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার পরিস্থিতি হবে না এমনটিই তার আশা।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’র আঘাত থেকে উপকূলীয় নগরবাসীকে রার্থে এবং সম্ভাব্য দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা, পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং করার জন্য সিটি করপোরেশন প্রস্তুতি নিয়েছে। গতকাল সকাল থেকে নগরীর দামপাড়ায় বিদ্যুৎ উপ শাখা কার্যালয়ে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। সম্ভাব্য দুর্যোগকবলিত এলাকার জনগণকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর, শুকনো খাবার, চিকিৎসাসেবার জন্য চিকিৎসক ও ওষুধপত্রসহ চিকিৎসাসামগ্রী এবং উদ্ধারকাজের জন্য উদ্ধারকর্মী ও ইকুইপমেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উদ্ধারকাজে ৫০০ কর্মী সার্বক্ষণিক মোতায়েন রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও মাইকে প্রচার করা হচ্ছে যাতে উপকূলীয় এলাকার অধিবাসীরা আশ্রয়কেন্দ্রে যান। ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে গতকাল সন্ধ্যায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
আতঙ্কিত মানুষ : চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করেন ৪০ লাখের বেশি মানুষ। তাদের জন্য সাইকোন শেল্টার রয়েছে এক হাজারের মতো। এর মধ্যে আবার ১০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্যোগকালে এসব কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে পারেন সাত-আট লাখ লোক। বাকি ৩২ লাখ লোকের ঠাঁই হয় না আশ্রয়কেন্দ্রে। অনেকেরই দূরের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া হয় না যানবাহনের অভাবে। তার উপর অধিকাংশ এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে সমুদ্রে মিশে গেছে। ফলে নিজেদের ঘরবাড়ি, চিংড়ি ঘেরসহ সহায়সম্পদ হারানোর ভয়ে তটস্থ থাকেন উপকূলীয় অঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষজন।
আবহাওয়া অফিস যা বলছেÑ
আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এটি গতকাল দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩০ কিলোমিটার পশ্চিম-দণিপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৯৫ কিলোমিটার পশ্চিম-দণিপশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫০০ কিলোমিটার দণিপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দণিপশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরো ঘনীভূত ও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আজ রোববার সকাল নাগাদ বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২-৩ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপের কারণে ২ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত থাকায় বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে ছোট লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। শনিবার সকাল পৌনে ১০টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরিশাল নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপপরিচালক আজমল হুদা মিঠু সরকার।
তিনি জানান, এ নিষেধাজ্ঞার ফলে সকাল ৮টা থেকে ৬৫ ফুটের নিচের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বরিশালে এমএল লিমা-২ ও এমএল বিসমিল্লাহ নামে এ ধরনের দুইটি লঞ্চ রয়েছে, যার মধ্যে একটি সকালে ছেড়ে গেলেও ফেরত আনা হয়। লঞ্চ চলাচলের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রুটের অন্য লঞ্চগুলোকেও সতর্কতা অবলম্বন করে চলাচলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ দিকে পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত বহাল রয়েছে।
শনিবান সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালে ১২ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। পাশাপাশি গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টির সাথে মৃদু বাতাস বইছে। ফলে, গত ৩ নভেম্বর যেখানে বরিশালের তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস সেখানে গতকাল এ তাপমাত্রা নেমে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন বরিশাল আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান।
পিরোজপুর সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় কায়ান্টের প্রভাব না কাটতেই আবারো নি¤œচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদী উত্তাল হয়ে উঠেছে। সেই সাথে দু’দিন ধরে একটানা বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার ফলে জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এ অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শনিবার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ফলে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাস হয়নি। অফিস-আদালত ছুটি থাকায় জেলা ও উপজেলা সদরসহ হাটবাজারে উপস্থিতি ছিল কম। দিনমজুররা কাজে বের হতে পারেননি। উপকূলবাসীর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মো: খায়রুল আলম শেখ বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের গতি বৃদ্ধি পেলে নদ-নদী তীরবর্তী ও নিচু এলাকার মানুষ এবং চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার জন্য আমাদের সব ইউনিটকে প্রস্তুত থাকার নিদের্শ দেয়া হয়েছে। জেলার সব সাইকোন শেল্টার ও আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রাখা হয়েছে। জেলেরা মাছ ধরতে যাননি। যে সব জেলে দুই-এক দিনের মধ্যে সাগরে ইলিশ শিকারে গেছেন তারাও নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন বলে জেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আব্দুস ছালাম জমাদ্দার জানিয়েছেন। সারা দিন বৃষ্টি আর দমকা বাতাসের কারণে গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন উপকূলীয় কৃষকেরা। তাদের ধারণা, আরো দুই-এক দিন বৃষ্টিপাত ও বাতাস হলে আমন ধানে পোকা হবে।
এ ব্যাপারে পিরোজপুর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার মো: হাসান ওয়ারিছুল কবির বলেন, এমন আবহাওয়া দীর্ঘস্থায়ী হলে আমন ধানের মারাত্মক ক্ষতি হবে। জেলা প্রশাসক জেলার মানুষদের শুকনো খাবার সংগ্রহ করে রাখার পরামর্শ দেয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সকল ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
কলারোয়া (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা জানান, নি¤œচাপের প্রভাবে কলারোয়া উপজেলায় শুক্রবার সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। রাস্তাঘাট জনমানব শূন্য। ভ্যানচালক আলিম জানান, সারা দিনে একটি ভাড়াও জুটছে না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। অনেকের মাঠে কাটা ধান ও ইটভাটাগুলোর কাঁচা ইট পানিতে ভিজে নষ্ট হচ্ছে।
হাতিয়া (নোয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে শুক্রবার থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয় এবং শনিবার সকাল থেকে তা বাড়তে থাকে। গতকাল সারা দিন হাতিয়া পৌরসভা এবং উপজেলার নলচিরা, চরকিং, চরইশ্বর, সুখচর, সোনাদিয়া, তমরদ্দি, বুড়িরচর, জাহাজমারা ও নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন এবং হরনী চানন্দী প্রশাসনিক এলাকায় দুর্যোগপূর্ণ বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। সকাল থেকে প্রচণ্ড বাতাস ও ভারী বৃষ্টিপাতের প্রভাবে নলচিরা ও তমরদ্দি ঘাট থেকে সি ট্রাক ও স্টিমার চলাচল বন্ধ ছিল। মাছ ধরার নৌকা ট্রলারগুলো মাছ ধরা বন্ধ রাখে।
টানা বৃষ্টির কারণে আমনধান কাটার অপেক্ষায় থাকা কৃষকের মাথায় হাত। দ্বীপের চরগুলোতে পাকা ধান কাটা শুরু না হতেই ঝোড়ো হাওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনজীবিকার বিঘœ ঘটেছে। রাস্তাঘাট দোকানপাট জনশূন্য হয়ে পড়েছে। শনিবার সকাল পর্যন্ত হাতিয়া আবহাওয়া অফিস ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়।
নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তাল বঙ্গোপসাগর
বরগুনা সংবাদদাতা জানান, বঙ্গোপসাগরে পাঁচ ট্রলার ডুবে তিন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। শনিবার সকালে এ ট্রলার ডুবি হয়। এ সময় এসব ট্রলার থেকে ৪৬ জেলেকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও তিন জেলে তলিয়ে গেছেন। বরগুনা জেলা ট্রলার সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রবল ঝড়ে সাগরে পাঁচটি ট্রলার ডুবে এখন পর্যন্ত তিনজন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজের নাম ও ঠিকানা এখনো পাওয়া যায়নি।
শরণখোলা (বাগেরহাট) সংবাদদাতা জানান, বঙ্গোপসাগরে উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে গতকাল শনিবার দুপুরে ৯০ জেলেসহ ছয়টি ফিসিং ট্রলার ডুবে গেছে। ঘটনায় তিন জেলে ও ১৫টি ট্রলার নিখোঁজ রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
পাথরঘাটা ফিসিং ট্রলার মালিক সমিতির সহসভাপতি নুরুল ইসলাম জানান, শনিবার দুপুরে ফেয়ারওয়ে বয়ার অদূরে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার সময় ঝড় ও প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে ছয়টি ট্রলার ডুবে যায়। ট্রলারগুলো হচ্ছে বরগুনার জেলার পাথরঘাটার জ্ঞানপাড়ার কাওসার মিয়ার ট্রলার, গুলিশাখালী এলাকার জাহাঙ্গীর মিয়ার এফবি ভাই ভাই, মহিপুরের গর্জনবুনিয়ার আলমগীর মিয়ার ফিসিং ট্রলার, একই এলাকার নাছির পাহলোয়ানের এফবি নাজমুল ইসলাম, ফোরকান মাঝির এফবি মা-বাবার দোয়া, কুয়াকাটার খাজুরা গ্রামের কাদের মাঝির এফবি শুকতারা। এ সব ট্রলারের প্রায় ৯০ জেলের সাগরে পড়ে গেলে অন্যান্য ট্রলারের জেলেরা ৮৭ জেলেকে উদ্ধার করেছে। তবে ১৫টি ট্রলারসহ তিন জেলের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ তিন জেলের নাম ও ঠিকানা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
কুয়াকাটা-আলীপুর ও মহিপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা তার এলাকার এফবি শুকতারা ট্রলার ডুবির বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বৈরী আবহাওয়ায় সাগরে অসংখ্য ফিসিং ট্রলার নিখোঁজ রয়েছে। এর মধ্যে কুয়াকাটার ইউসুফ মিয়ার এফবি নুর বানু, আবুল হোসেনের এফবি আল রোমান, রতন মিয়ার এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পেরেছেন।
বরগুনা জেলা ফিসিং ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মান্নান জানান, ঝড়ো হাওয়ায় পাথরঘাটা, বরগুনা, মহিপুর, আলীপুর, শরণখোলাসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক ট্রলারের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ সব ট্রলারের সাথে মোবাইল ফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে ট্রলার মালিক ও জেলেদের স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
নোয়াখালী সংবাদদাতা জানান, নোয়াখালীতে টানা ভারী বর্ষণে জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়া ও সমুদ্র উত্তাল থাকায় গতকাল সকাল থেকে জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ার সাথে নোয়াখালীর চেয়ারম্যান ঘাটের নৌ চলাচল বিচ্ছিন্ন রয়েছে। হাতিয়ার সাথে চেয়ারম্যান ঘাটের সিট্রাকসহ সব ধরনের নৌ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞার ২২ দিন পর সাগরে ইলিশ আহরণে গিয়ে ঘূর্ণিঝড় নাডার কবলে পড়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলার সাত শতাধিক ফিশিং বোট। পরে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সব ফিশিং বোট নিরাপদে কূলে ফিরে এলেও বাঁশখালীর প্রায় ৪৫ মাঝিমাল্লাসহ তিনটি ফিশিং বোটের কোনো সন্ধান পাওয়া না গেলেও গতকাল রাত ৮টায় তাদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ হয়েছে বলে জানান বাঁশখালী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি এয়ার আলী। এর আগে ৪৫ মাঝিমাল্লা নিখোঁজের খবরে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল জেলে পল্লীগুলোতে।