৪ দশক পর উন্মুক্ত হলো চার নেতার স্মৃতি

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

38517_f2

ঢাকা;  পঁচাত্তরের ৩রা নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ৩রা নভেম্বর। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে চার দশকের বেশি সময়। ৩রা নভেম্বর মানেই সেই কালরাত। যেদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে নির্মম ও নৃশংসতায় ঘাতকেরা হত্যা করেছিল জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে। কারাগারকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান। কিন্তু সেই কারাগারেই তাদের প্রাণ কেড়ে নেয় হিংস্র হায়েনাসম একদল ঘাতক। এতদিন এ কাহিনী শুধু পত্রিকায় পড়ে ও শুনেই আসছিলেন সাভারের সত্তরোর্ধ্ব বিমল সরকার। তার শেষ জীবনের আকাঙ্ক্ষা ছিল জাতীয় চার নেতাকে যেখানে হত্যা করা হয়, সেই স্থানটি দেখার। চার দশক ধরে অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে তার সেই লালিত স্বপ্ন গতকাল পূরণ করেছেন বিমল সরকার। আলাপকালে তিনি বলেন, তার দীর্ঘ দিনের অব্যক্ত বেদনার কথা। বলেন, এই কারাগারের কথা অনেক শুনেছি। এখানে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতি রয়েছে। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল এখানে আসার। সেজন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছি। ভাবিনি সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। আজ (গতকাল) সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। এমন একটি ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকার ও কারা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। শুধু বিমল সরকারই নন, বিভিন্ন বয়সী নারী, পুরুষ ও শিশুরা তাদের স্বপ্ন পূরণ করার সুযোগ পেয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষের একটি সিদ্ধান্তে। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার কয়েকদিন সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ১০০ টাকার বিনিময়ে দু’ঘণ্টার জন্য তারা এ ঐতিহাসিক কারাগার পরিদর্শনের সুযোগ পাবেন। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতি বিজড়িত জাদুঘর রয়েছে।
২২৮ বছরের পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এখন শুধুই স্মৃতি। এখানে এখন বন্দি হাজতি কিংবা কয়েদি নেই। আছে দেখা এবং মনে রাখার মতো স্মৃতির চিহ্ন। রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা এ কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাই, বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ কারাগার। এটি এখন জাতির পিতা এবং জাতীয় চার নেতার স্মৃতি বিজড়িত। কারাগারের ভেতর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর কারা স্মৃতি জাদুঘর এবং জাতীয় চার নেতা কারা স্মৃতি জাদুঘর সর্বসাধারণের দর্শনের জন্য ব্যবস্থা করেছে কারাকর্তৃপক্ষ। গতকাল থেকেই শত শত নারী, পুরষ এ দুটি জাদুঘর পরিদর্শনে এসে তৃপ্ত মন নিয়ে ঘরে ফিরেছেন।
কারাগারের মূল ফটক পার হয়ে ডানদিকে চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘সংগ্রামী জীবনগাঁথা’। এখানে বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু দুর্লভ স্থির চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। ৩রা নভেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা কারা স্মৃতি জাদুঘর এবং আলোকচিত্র প্রদর্শনী পরিদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যা চলবে ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত। গতকাল দিনভর পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার ঘুরে দেখা গেছে মানুষের ঢল। তবে, সবার আগ্রহ ছিল ওই কারাগারের দুটি জাদুঘরকে ঘিরে।
মূল ফটক পার হয়ে বামদিকে একটু এগুনোর পর ‘নীলনদ’ সেল (বিদেশি বন্দিদের রাখা হতো এখানে)। এর পাশেই জাতীয় চার নেতার কারা স্মৃতি জাদুঘর। মূল ফটকের সামনে একটি বেদি। হত্যার পর যেখানে রাখা হয়েছিল চার নেতার লাশ। একটু ভেতরে এগুলে চার নেতার আবক্ষ ভাস্কর্য। প্রত্যেকের ভাস্কর্যের নিচে সংক্ষিপ্তাকারে লেখা তাদের রাজনৈতিক ও কর্মময় জীবনের কিছু বিবরণ। পাশেই জাতীয় চার নেতার ‘মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ স্মৃতি কক্ষ’। সামনে দাঁড়ালে ডানদিকের কক্ষটি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ, দ্বিতীয়টি এএইচএম কামরুজ্জামান এবং এরপরের কক্ষ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর নামে। প্রতিটি কক্ষেই কারাগারে থাককালীন সময়ে চার নেতার ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। রয়েছে ঘাতকদের ছোঁড়া গুলির চিহ্ন।
কারাগারের অভ্যন্তরে হওয়ায় চার দশক পর্যন্ত এ ঐতিহাসিক স্থান দেখার সুযোগ পাননি সাধারণ মানুষ। গতকাল একদিকে ছিল দীর্ঘদিন ধরে চারনেতার স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর দেখার উৎফুল্লতা। অন্যদিকে জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকেই হয়েছেন বিষণ্ন। একই সঙ্গে পরিদর্শন শেষে চোখেমুখে পরিতৃপ্তির আভা যেমন ছিল তেমনি ভারাক্রান্ত ও বিষণ্ন মনে ফিরে গেছেন তারা। তাদের সবার দাবি, ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে জাতীয় চার নেতার স্মৃতিবিজড়িত এই স্থান দেখার সুযোগ ছিল না। এখন এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। বংশালের এএফএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা জহুরা বেগম তার তিন নাতি নাতনিকে নিয়ে এসেছিলেন পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। আলাপকালে তিনি বলেন, অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল কারাগারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর দেখার। কিন্তু এতদিন কারাগারে প্রবেশ সম্ভব হয়নি। এবার সে সুযোগ পেয়েছি। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানতে হবে। তাই তাদেরও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তারাও খুব খুশি। পুরান ঢাকার নারিন্দা থেকে স্ত্রী, মেয়ে ও আত্মীয়দের নিয়ে এসেছিলেন আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, এতদিন শুধু শুনেই আসছি। আজ (গতকাল) এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। বাচ্চারাও এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *