বস্তির ছেলেমেয়েরা পড়তে যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকায়

Slider সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সারাবিশ্ব

file

ঢাকা; মারিয়া কনসিকাও। মানবহিতৈষী পর্তুগিজ নারী। যার ধ্যান-জ্ঞান ঢাকার সুবিধাবঞ্চিত বস্তিবাসী শিশুদের ঘিরে। এসব শিশুদের জীবনের শুরু থেকেই দেশে-বিদেশে ব্যয়বহুল উন্নত শিক্ষা ও কর্মসংস্থান গড়ে দিতে মরিয়া তিনি। এই মহান ব্রতে বিসর্জন দিয়েছেন নিজের সুখ-শান্তি। তহবিল গঠন করতে বেছে নিয়েছেন বিরল ও কঠিন সাধনা। কঠিন পরিশ্রমে একে একে দুঃসাধ্য সাধন করে চলছেন। ১০ লাখ ডলারের তহবিল সংগ্রহের চেষ্টায় সাত মহাদেশে ম্যারাথন দৌড়ে গিনেস বিশ্বরেকর্ড ‘৭৭৭ চ্যালেঞ্জ’ গড়েন। প্রথম পর্তুগিজ নারী হিসেবে জয় করেছেন এভারেস্ট। পর্তুগালে ‘উইমেন অব দ্য ইয়ারে’ ভূষিত হয়েছেন। তবে ৬ মাসের কঠিন সাধনায় ইংলিশ চ্যানেল পার হতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু থেমে নেই মারিয়া। বাংলাদেশের শিশুদের উন্নত জীবন দিতে আরো কঠিনতর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সংকল্পে এগিয়ে যাচ্ছেন। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের বিমানবালা এই পর্তুগিজ নারী এভাবে জয় করে চলছেন ঢাকা।
চাকরির সুবাদে ২০০৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন মারিয়া। যাত্রাবিরতির সুযোগে ঢাকা শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের আশপাশে হেঁটে দেখেন। তখন  স্বল্প বয়সী হতদরিদ্র বস্তিবাসী শিশুদের হাত পেতে ভিক্ষা করতে দেখে মনে কষ্ট পান। এরপর ঢাকার কয়েকটি বস্তি পরিদর্শন করেন। তাতে তার মর্মবেদনা আরো বাড়ে। মানুষের কষ্ট দেখে আর স্থির থাকতে পারেন নি এই মানবতাবাদী নারী। এদের জন্য কিছু করার চিন্তা-ভাবনা পেয়ে বসে তাকে। শিশুদের উন্নত শিক্ষা ও পরিবারগুলোর কর্মসংস্থানই তাদের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করার সমাধান হিসেবে ভাবতে থাকেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। নিজের আয়ের টাকায় তাদের সেবা করার জন্য নেমে পড়েন তিনি।
২০০৫ সালে বস্তিবাসীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। নিজের বেতনের টাকায় প্রথমে ঢাকা প্রজেক্ট নাম দিয়ে কাজ শুরু হয়। মহাখালীর কড়াইল বস্তি থেকে ৪০টি দরিদ্র পরিবারকে বিমানবন্দরের পূর্ব পাশে দক্ষিণখানের গাওয়াইর এলাকায় ভাড়া বাসায় পুনর্বাসন করেন। তাদের পরিবহন খরচসহ ৬ মাস থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের খরচ বহন করেন মারিয়া। এর মধ্যে মহিলাদের সেলাই মেশিন, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থান করে দেয়া হয়। পুরুষদের দেয়া হয় ড্রাইভিংসহ বেশকিছু প্রশিক্ষণ। আর তাদের সন্তানদের উন্নত শিক্ষার জন্য খোলা হয় স্কুল। গাওয়াইরে ৩৯ শিশু নিয়ে ২০০৫ সালে শুরু হয় প্রথম শিক্ষা কার্যক্রম। তখন থেকেই খাতা-কলম, ব্যাগ, টিফিন, চিকিৎসা, ওষুধ, চাল-ডালসহ শিশুদের যাবতীয় ব্যয়ভার তিনিই বহন করে আসছেন। পরের বছর বিভিন্ন ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। ২০০৭ সালে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এর দ্বিগুণ ছাড়ায়। পৌঁছে প্রায় ৫০০ জনে। ২০১৩ সালে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচশতাধিক ছাত্রছাত্রী হয় তার স্কুলে। তিনি প্রতিবছর ২ থেকে ৩ বার এদেশে ছুটে আসেন। প্রতিবার ১ থেকে ২ সপ্তাহ অবস্থান করে শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষার বিষয় তদারক করেন। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেন। সমাধান করেন সমস্যাগুলো। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর থেকে মারিয়া পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও এয়ারলাইন্সের আর্থিক সহায়তা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালে তিনি অর্থসংকটে পড়েন। বন্ধ হয়ে যায় স্কুলের কার্যক্রম। এক বছর বন্ধ থাকে কার্যক্রম। এরপর ঝরে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী। অনেকে অন্যান্য স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু বঞ্চিত হন ভালোমানের পড়াশুনা থেকে। ২০১৪ সালে তিনি আবার শিক্ষার্থীদের তুলে এনে কাজ শুরু করেন। আর ওই ঢাকা প্রজেক্টের নাম পরিবর্তন করেন। নিজের পালক মায়ের নামে মারিয়া ক্রিস্টিনা ফাউন্ডেশন নামকরণ করেন। আবার খুঁজে আনেন তার প্রাণপ্রিয় সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের। তবে একটু ভিন্নভাবে। তিনি এবার আর নিজে স্কুল খুলেননি। শিশুদের পড়ানোর জন্য খুঁজতে থাকেন ঢাকায় নির্ভরযোগ্য ভালোমানের স্কুল-কলেজ। পরে তিনি উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ইংলিশ মিডিয়াম মাহাদ স্কুলে সম্পূর্ণ নিজের খরচে ১২০ জন ছাত্রছাত্রীকে ভর্তি করান। ক্যামব্রিয়ান স্কুলে ভর্তি করান ৪১ জনকে। আর চলতি বছর সম্পূর্ণ তার খরচে ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১৩৩ জন শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। ইংলিশ মিডিয়াম মাহাদ স্কুলে পড়ছে ৩৯ হতদরিদ্র ছেলেমেয়ে। ক্যামব্রিয়ানে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিবছর ১ হাজার ডলার খরচ করতে হয়। এতেই তাদের বই-খাতা থেকে শুরু করে সব কিছুর খরচ চলছে। আর মাহাদেও শিক্ষার্থীদের জন্য বড় অঙ্কের টাকা প্রদান করতে হয়। মাইলস্টোনেও কয়েকজন শিক্ষার্থীর খরচ যোগাচ্ছে মারিয়া ফাউন্ডেশন।
এদিকে চলতি বছর মারিয়া ফাউন্ডেশনের খরচে পড়া ২২ শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল নিয়ে এসএসসি পাস করেছে। এরমধ্যে ২জন এ প্লাস পেয়েছে। আর এইচএসসি পাস করেছেন ৯ জন। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন জাকির। এরমধ্যে বেশ ক’জনকে পড়াশুনার জন্য নিয়ে গেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকায়।
মারিয়ার বরাত দিয়ে ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর মো. শফিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ‘মারিয়া আপা বলেছেন যে, তোমাদের জন্য এত কষ্ট করছি। একজন টিকলো কেন। বাকিরাও কেন টিকেনি। সবার উচ্চ শিক্ষার সব খরচও মারিয়া চালিয়ে যাবেন বলে জানান তিনি।
শুধু দেশে নয়। বিদেশেও ব্যয়বহুল পড়াশুনা করিয়ে যাচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিতদের। কর্মসংস্থান করে যাচ্ছেন দরিদ্র বহু পরিবারকে। এর মধ্যে তিনি ৮ শিক্ষার্থীকে দুবাই নিয়ে যান পড়ার জন্য। এর মধ্যে ৬ জন এখন এ এবং ও লেভেল এবং উচ্চ শিক্ষা অর্জনে দুবাই ও আমেরিকায় পড়ছেন। এর মধ্যে মিলন, তসলিম, সুজনসহ চার জন দুবাইয়ে এ এবং ও লেভেলে। শিউলী দুবাই মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডা যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আর গ্রামে বাল্যবিয়ের পর স্বামীর নির্যাতন থেকে উদ্ধার করে পড়াশুনার সুযোগ করে দেয়া বিলকিস মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনার পর এখন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করছে।
এতেই শেষ নয়। প্রথমদিকে স্কুলে পিয়ন হিসেবে কাজ করা নুরুল ইসলাম এখন দুবাইয়ে লক্ষাধিক টাকায় চাকরি করছেন। বেশি বেতনে দুবাইয়ে মারিয়া কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন আলাম মিয়া, আজারসহ ছয় জনের।
গতকাল দুপুরে আবদুল্লাহপুরে ক্যামব্রিয়ান স্কুলের তৃতীয় ও চতুর্থসহ কয়েকটি শ্রেণি কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে। খেলাধুলা করছে। শিখছে সংগীত। সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের পোশাক ও মার্জিত ব্যবহার দেখে বুঝার উপায়ই নেই যে, তারা হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তবে তাদের কথায় জানা গেল, একজন মারিয়া না থাকলে তাদের উন্নত জীবনের এ স্বপ্নও অধরা থেকে যেতো।
একটি অফিসে ঝাড়ুদারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা বৃদ্ধা আমেনা বেগম বলেন, আমার মেয়ে শিউলীকে বিয়ে দেয়ার পর আমার এই নাতি রিদোয়ান খানের বয়স দু’বছর থাকতেই তার বাবা মাসুদ নিখোঁজ হয়। সেই থেকে বাসায় তারাও আমার সঙ্গে দুঃখের জীবন পার করছে। আমার তিন হাজার টাকা বেতনেই চলছে ১ হাজার ৫০০ টাকা বাসাভাড়াসহ তিনজনের পরিবার।  মারিয়ার স্কুলে আমার নাতি পড়ছে। এ স্কুলে পড়ার সুযোগ না পেলে তাকে পড়ানোই সম্ভব ছিল না। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া রিদুয়ান খান ইংরেজিতে বলেন, মারিয়া আপা আসলে আমাদের খুব আদর করেন। ভালোবাসেন। অনেক উপহার নিয়ে আসেন। বই-খাতাসহ সবকিছু দেন। পড়াশুনা করে কী হতে চাও জানতে চাইলে বলে, আমাদের দেশে অনেক সমস্যা। উন্নত দেশে তা কম। সমস্যাগুলো সমাধান করে এদেশকে উন্নত করার জন্য আমি একজন বিজ্ঞানী হবো। পরের বাসায় ৩ হাজার ২০০ টাকায় কাজ করে চার ছেলেমেয়েসহ ৫জনের সংসার চালান স্বামী পরিত্যক্ত খাদিজা আক্তার মরিয়ম। তার তিন মেয়ে রাহিমা আক্তার রিয়া, খাদিজা আক্তার ও লাকী আক্তার ক্যামব্রিয়ানে পড়ছে। রিয়া বলে, মারিয়া না থাকলে পড়াশুনা কী? তাই হয়তো জানতাম না। আমি ডাক্তার হতে চাই। এদিকে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উন্নত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য বার বার তহবিল সংকটে পড়ছেন মারিয়া। কিন্তু দেশে তাকে কেউ কোনো ধরনের সহায়তা এ পর্যন্ত দেয় নি। তিনি নিজের সর্বস্ব দিয়েও কুলাতে না পেরে একের পর এক কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সংগ্রহ করছেন তহবিল। যা সমাজে বিরল। ১০ লাখ ডলারের তহবিল সংগ্রহের চেষ্টায় তিনি পরপর সাত দিনে সাতটি মহাদেশে সাতটি ম্যারাথন দৌড় শেষ করার কঠিন সংকল্প করেছিলেন। কিন্তু বাদ সাধে বৈরী আবহাওয়া। তবু সংকল্পে দৃঢ় মারিয়া। শেষ পর্যন্ত ১১ দিনের মাথায় ‘৭৭৭ চ্যালেঞ্জ’ খ্যাত এই লক্ষ্য অর্জন করেন। আগের ৪৮ দিনের রেকর্ড ভঙ্গ করে ১০ দিন ২৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে গড়েন নতুন রেকর্ড। প্রতিটি মহাদেশে ম্যারাথন ও আল্ট্রাম্যারাথন সম্পন্ন করার মোট সময়েও  রেকর্ড বুকে তিনিই এগিয়ে রয়েছেন। নতুন তিন রেকর্ডসহ এখন মারিয়া মোট ছয়টি বিশ্বরেকর্ড গড়েন। পর্তুগিজ এই নারীর অনন্য উদ্যোগ ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।
পর্তুগালের পুরুষদের ফ্যাশন, সংস্কৃতি ও লাইফস্টাইল ভিত্তিক সাময়িকী জি কিউ সাধারণত ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার দিয়ে থাকে। তারা এবার ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে মারিয়াকে ‘উইম্যান অব দ্যা ইয়ার’ ঘোষণা দেয়। এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, মারিয়ার অর্জন নিয়ে জিকিউ পর্তুগাল এতটাই অভিভূত যে, সাময়িকীটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তারা ‘ম্যান অব দ্য ইয়্যার’ প্রদানের বদলে একজন নারীকে সম্মানিত করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *