উদীয়মান বাংলাদেশ: টাইগার ইন দ্য নাইট

Slider টপ নিউজ সারাবিশ্ব

35693_naz-3

 

১৯৮৬ সালে সর্বশেষ যখন একজন চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, পরিস্থিতি বরং ভিন্ন ছিল। একটি কারণ হতে পারে যে, তিনি পকেটে করে ৪০ বিলিয়ন ডলার আনেননি। সরকারী সূত্রগুলো বলছে, ঠিক এ পরিমাণ অর্থই চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিং ১৪ই অক্টোবর একদিনের সফরে নিয়ে আসছেন। স্পষ্টত, উড়াল পথ, রেলপথ, সেতু ও বিদ্যুতকেন্দ্র সহ প্রায় ২১টি অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ঋণের রূপে আসবে এ অভাবনীয় অর্থ। কিন্তু স্বাগত জানানোর কায়দা আগের মতোই।
৩০ বছরে বাংলাদেশও পাল্টেছে অনেকখানি। যদিও ১৬ কোটি জনসংখ্যার বেশিরভাগ এখনও দরিদ্র্যই রয়ে গেছে, কিন্তু দেশটিকে আর ‘ভারতের বগলতল’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বার্ষিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে প্রবৃদ্ধি, ঠিক চীনের মতো। অনেক সামাজিক সূচকের দিক দিয়ে মহাকায় প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। দেশটির উদীয়মান পোশাক শিল্প রপ্তানির দিক দিয়ে পিছিয়ে কেবল চীন থেকে। এ শিল্প ও প্রায় ১ কোটি প্রবাসী কর্মঠ শ্রমিকের পাঠানো টাকায় বাংলাদেশ গত ১০ বছরে একবার বাদে প্রতি বছর উদ্বৃত্ত ভোগ করেছে।
এখন অন্যান্য পাণিপ্রার্থীও পেয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি চীনকে হটিয়ে নতুন একটি সমুদ্রবন্দর নির্মানের কাজ পেয়েছে জাপান। ৬৭০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে আছে একটি গ্যাস টার্মিনাল ও ৪টি কয়লা চালিত বিদ্যুতকেন্দ্র। জুলাইয়ে একজোড়া পারমাণবিক চুল্লি নির্মানে রাশিয়া ঋণ হিসেবে ১১৪০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ বছরের গোড়ার দিকে, ভারত আরেকটি বড় কয়লা চালিত বিদ্যুতকেন্দ্রে ১৫০ কোটি ডলার অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি দেশটি বাংলাদেশকে নিজ গ্রিড থেকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাও নিজেদের সহায়তা বৃদ্ধি করেছে। বলা বাহুল্য চীনের অনেক কিছুতে বধির থাকবেন শেখ হাসিনা। কারণ, সাম্প্রতিক বলবান স্বাস্থ্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতির এখনও সব ধরণের সাহায্য প্রয়োজন।
রাজধানীর ১.৭ কোটি বাসিন্দার (জাতিসংঘের অনুমান, ২০৩০ সালে হবে ২.৭ কোটি) জন্য যানজটের স্বস্তি শিগগিরই আসবে না। গণপরিবহন সিস্টেমের জন্য বর্তমানে কোন পরিকল্পনা নেই। শহরজুড়ে তিন ধাপের এক্সপ্রেসওয়ের প্রথমটিও ২০১৮ সালের আগে খুলবে না। আবার দেশের প্রায় ১.৩ কোটি পরিবারে বিদ্যুৎ নেই। এমনকি বিদেশী অর্থায়নে নির্মিতব্য সব বিদ্যুতকেন্দ্র যোগ করলেও, ভবিষ্যতে জ্বালানী সঙ্কটে ভুগতে পারে বাংলাদেশ। এডিবির সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে ইঙ্গিত মিলেছে যে, প্রত্যাশিত চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সাল নাগাদ সক্ষমতা তিনগুণ করতে হবে বাংলাদেশকে। ওই প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, শুধু নতুন কেন্দ্র নির্মান করলেই চলবে না, পুরোনো কেন্দ্রগুলোও প্রতিস্থাপন করতে হবে।
কিন্তু এরপরও সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বোধ হয় রাজনৈতিক। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। দলটি ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুখোমুখি হবে একটি দুর্বল বিরোধী দলের। তবে এর মানে এই নয় যে, আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়। ২০১৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচন বেশিরভাগ বিরোধী দলই বয়কট করেছিল। ওই নির্বাচন ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এবং ফলস্বরূপ দেখা মিলে কার্যত একদলীয় একটি পার্লামেন্টের। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ সরে গেছে দেশটিতে কট্টরপন্থীদের একটানা রক্তাক্ত সব হত্যাকা-ের দিকে। এসবের চূড়ান্ত পরিণতি পায় জুলাইয়ে ঢাকার এক বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় হামলার মধ্য দিয়ে, যাতে নিহত হয় ২০ জন মানুষ যাদের বেশিরভাগ বিদেশী। কিন্তু বাংলাদেশীদেরকে যা সবচেয়ে উদ্বিগ্ন করে, তা হলো অনেকের মতে, আইনের শাসনের ব্যাপক পতন।
১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার পর উল্লেখযোগ্য দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে বটে। কিন্তু ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ঐতিহ্য রয়েছে বাংলাদেশের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগ, যেটি নিজেও পূর্বের সহিংসতার শিকার, সেই দল প্রতিহিংসা নিয়ে খড়গহস্ত হয়েছে প্রতিপক্ষের ওপর।
দেশের বৃহত্তম বিরোধী গোষ্ঠী বিএনপি’র মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত, বিচারবিভাগ নিয়ন্ত্রিত। পুলিশ এখন নিজেদের প্রভুদের চেয়েও বেশি উৎসাহী।’ ইসলামপন্থী ও অন্যান্য ভিন্নমতালম্বীদের টার্গেট করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও গুম ছাড়াও, শাসক দল বিপুল সংখ্যাক মামলা দায়ের করেছে। শুধুমাত্র বিএনপির বিরুদ্ধেই মামলা আছে ৩৭ হাজার। বিড়বিড় করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি সপ্তাহের চারটি দিনই আদালতের শুনানিতে উপস্থিত হয়ে কাটাই। প্রত্যেকটির জন্য যানজটে আটকে থাকি ২ ঘন্টা।’
এশিয়ান টাইগারদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মতো, রাজনীতি আরও গণতান্ত্রিক হওয়ার আগে বাংলাদেশকেও সম্ভবত কিছুকাল স্বৈরতন্ত্র সহ্য করতে হবে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ টাঙান দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে, ঠিক যেমনটা মাথা ঝাঁকি দিয়ে বললেন ঢাকার একটি এনজিওর প্রধান। তার ভাষায়, ‘অসন্তোষ প্রকাশের জন্য মানুষের কোন উপায় না থাকাটা বিপজ্জনক।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *