উত্ত্যক্তকারীরা থামছে না

Slider জাতীয়
5f06aaed75b23905d0df0369614a233e-untitled-44
ঢাকা; রিসার পর নিতু। মাত্র ২৫ দিনের ব্যবধানে উত্ত্যক্তকারীদের নির্মমতার শিকার হলো দুই স্কুলছাত্রী। আবার বখাটেপনার প্রতিবাদ করেও জীবন হারানোর ঘটনা ঘটেছে নিকট অতীতে। ফলে এ নিয়ে সমাজে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে।
গত রোববার মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নবগ্রামের নিতু মণ্ডলকে (১৪) স্কুলে যাওয়ার পথে কুপিয়ে হত্যা করে একই গ্রামের যুবক মিলন মণ্ডল। আর রাজধানীর স্কুল থেকে বের হওয়ার পর বখাটে ওবায়দুলের ছুরির আঘাতে আহত হয় সুরাইয়া আক্তার রিসা। এ ঘটনা গত ২৪ আগস্টের। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী চার দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে উত্ত্যক্তের শিকার হয় ৩৬২ জন নারী ও শিশু। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিকার না পেয়ে ক্ষোভে, অপমানে আর মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২২ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আট মাসে উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ১৮১ জন, এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছে ৫ জন। ১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে এই পরিসংখ্যান পেয়েছে মহিলা পরিষদ।
খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বললেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনকি শহর এলাকায়ও স্কুল, কলেজগামী ছাত্রীদের ওপর উত্ত্যক্তকারী সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলার খবর অভিভাবকদের বিচলিত করে। অভিভাবকেরা মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে ভয়াবহ মানসিক দুশ্চিন্তায় থাকেন। অসহনীয় পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়ার খবরও পাওয়া যায়।

অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী এও মনে করেন, সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে ছাত্রীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা অনেক কমে এসেছে। গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইভ টিজিং প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠক থেকেই টেলিফোনে শিক্ষামন্ত্রী মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নিতুর হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বখাটেরা একটু ভয় পেত। তিনি বলেন, যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধে একটি আইনের খসড়া দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায় আছে, কিন্তু সেটিও সেভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

কোমলমতি নিতু-রিসা: নিতু ছিল মাদারীপুরের নবগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। প্রতিবেশী মিলন মণ্ডল তার গৃহশিক্ষক। নিতুর পরিবারের অভিযোগ, গৃহশিক্ষক হয়েও কিছুদিন ধরে নিতুকে উত্ত্যক্ত করছিলেন মিলন। গত ৫ আগস্ট তাকে বাড়িতে একা পেয়ে মারধরও করেন তিনি। বিষয়টি মিলনের পরিবারকে জানান নিতুর বাবা নির্মল মণ্ডল। কিন্তু মিলনের পরিবার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নিতুকে কুপিয়ে ফেলে যাওয়ার সময় গ্রামবাসী মিলনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।

অন্যদিকে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিসা উত্ত্যক্ত হওয়ার কথা তার মা তানিয়া হোসেনের কাছে বললেও বাবা রমজান হোসেনকে কখনো জানায়নি। গতকাল সোমবার টেলিফোনে রমজান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাচ্চাটা যদি আমারে বলত, আমি বাচ্চাকে একা ছাড়তাম না, স্কুলে দিয়া আসতাম, নিয়া আসতাম। কিন্তু দুশ্চিন্তা করব ভেবে আমারে জানায়নি।’ স্ত্রীর অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মাত্র দুই মাস আগে ছোট ছেলেমেয়ের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য ভ্যান ঠিক করেন বাবা রমজান। ভ্যানে ওঠার জন্য স্কুল থেকে বের হয়ে পদচারী-সেতু পার হওয়ার সময় হামলার শিকার হয় রিসা।

এ ঘটনায় মা তানিয়া হোসেন রমনা থানায় ওবায়দুলকে আসামি করে মামলা করেন। এরপর রিসার সহপাঠীদের আন্দোলনের মুখে সক্রিয় হয় পুলিশ এবং গত ৩১ আগস্ট ওবায়দুলকে (২৯) গ্রেপ্তার করে।

প্রতিবাদ করে প্রতিশোধের মুখে: চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মজিবর রহমান (৬৭) ও তাঁর ছোট ভাই মিজানুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় পুলিশ পরে উত্ত্যক্তকারী যুবককে গ্রেপ্তার করেছে। মামলাটি এখন সিআইডি তদন্ত করছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ শহরের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজের শিক্ষার্থী মুহ্‌তাসিন বিল্লাহকে হত্যা করা হয়। একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় তাঁকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় পরে একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।

২০১৪ সালে মামাতো বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বখাটেদের পিটুনিতে প্রাণ হারান নাসির হোসেন। রাজধানীর পশ্চিম ভাষানটেকের গোলটেক এলাকায় ঘটে এ ঘটনা।

প্রতিকারের উপায়: ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট বিভাগ যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি নির্দেশনামূলক রায় দেন। এই রায়ে মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ সর্বস্তরে নারীর ওপর যৌন হয়রানিমূলক আচরণ প্রতিরোধে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কেউ অশোভন আচরণের শিকার হলে নিকটস্থ থানায় বা দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে জানাতে পারেন। অনলাইনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করার সুযোগ আছে।

আবার দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী, কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার ইচ্ছায় কোনো মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি বা যেকোনো প্রকারের কাজের শাস্তি এক বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় প্রকারের দণ্ড। ঢাকা মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশের ৭৬ ধারা অনুযায়ী, নারীদের উত্ত্যক্ত করার শাস্তি কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, যৌন কামনার উদ্দেশ্যে কোনো অঙ্গ স্পর্শ করলে বা শ্লীলতাহানি করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর সাজা এবং সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে আইনি সহায়তা নেওয়ার নজির কম। এই অপরাধীদের শুধু ধরলেই হবে না, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আশার বিষয়, রিসা ও নিতুর হত্যাকারীকে ধরতে জনগণ সহায়তা করেছে। গণমাধ্যমও ভূমিকা রাখছে। সরকারের সব পক্ষকে এখন আরও তৎপর হতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *