মানবিকতার মৃত্যু

Slider জাতীয় সারাদেশ

32081_f1

 

ঢাকা: অমানবিক। অবিশ্বাস্য বর্বরতা। মানবিকতার মৃত্যু। কোনো কিছুতেই ব্যাখ্যা করা যায় না এসব ঘটনা। ঘটছে একের পর এক। এ কি বিকারগ্রস্ত মানসিকতা? সামাজিক বিপর্যয়ের ফল? কোনো উত্তরই আসলে নেই।
বৃহস্পতিবার বিকালে ফরিদপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথাই ধরুন না কেন। নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কিনে দিতে হবে। ১৭ বছরের ছেলে ফারদিন হুদা মুগ্ধর এই চাওয়া পূরণ করতে পারেন নি বাবা-মা। ক্ষুব্ধ ছেলে আগুন দিয়ে হত্যার চেষ্টা করলো বাবা-মাকে। এটিএম রফিকুল ইসলাম দম্পতি ফরিদপুরের কমলাপুর ডিআইবি বটতলা এলাকার বাসিন্দা। দগ্ধ রফিকুলের শরীরের ৫০ ভাগের বেশি পুড়ে গেছে। বার্ন ইউনিটে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনি। তার ভগ্নিপতি আকরাম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, এ বছর ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করা মুগ্ধ বাবার কাছে একটি নতুন মডেলের মোটরসাইকেল দাবি করে। কিন্তু, বাবা কিনে দিতে রাজি না হওয়ায় সে ক্ষুব্ধ হয়। একটা সময়ে মুগ্ধ ঘরের মধ্যে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় মা-বাবার গায়ে। এতে রফিকুলের শরীরের বিভিন্ন জায়গা এবং তার স্ত্রীর পায়ের কিছু অংশ পুড়ে যায়। রফিকুলের ভাগ্নে ইফতেখার আলম বলেন, নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কেনা নিয়ে মামা-মামির সঙ্গে মুগ্ধর ঝগড়া চলছিল। হঠাৎই ঘরে থাকা পেট্রল দিয়ে সে আগুন ধরিয়ে দেয় তাদের গায়ে। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
মুগ্ধ’র অমানবিকতার কাহিনীর রেশ এখনও শেষ হয়নি। এরইমধ্যে ঘটেছে অন্তত এমন আরো তিনটি বর্বর ঘটনা। শনিবার চট্টগ্রামে ছেলের হাতে খুন হয়েছেন মা। এরপর ছেলে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সুমিত চৌধুরী কেন তার মা কুমকুম চৌধুরীকে হত্যা করলো তা এখনো রহস্য। যতটুকু জানা যাচ্ছে, পরীক্ষায় পাস না করার কারণে বড় ভাই সোমনাথ চৌধুরী বকাঝকা করেছিলেন সুমিত চৌধুরীকে। এর দুই ঘণ্টার মধ্যেই খুব সম্ভবত, মাকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করে সুমিত। তাকে এরইমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছে। অথচ অনেকদিন থেকেই অসুস্থ মায়ের সেবা করে আসছিলো সুমিত। সুমিত কেন সেই মাকে হত্যা করলো তার ব্যাখ্যা মিলছে না। এ যেন ব্যাখ্যাতিত অমানবিকতারই সময়। এই অমানবিক ঘটনা নিয়ে যখন চারদিকে নানা বিশ্লেষণ চলছে তখন আরেক নিষ্ঠুর ঘটনার খবর এলো রাজশাহী থেকে। সাত বছরের সন্তানকে কুপিয়ে হত্যার পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মা। একটি সূত্রে অবশ্য খবর পাওয়া যাচ্ছে, তার মানসিক সমস্যা রয়েছে। ওদিকে, রংপুরে ২২ মাস বয়সী শিশুকন্যাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে বাবার বিরুদ্ধে। রোববার সকালে নগরীর তাজহাট এলাকা থেকে আরিফা নামের শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মৃত আরিফা আলাল হোসেনের মেয়ে। ঘটনার পর থেকে আলাল পলাতক রয়েছে। আরিফার মা সেবা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, এক বছর ধরে চট্টগ্রামে স্বামীর সঙ্গে থাকি। সেখানে আমার স্বামীর সঙ্গে অন্য এক মেয়ের সম্পর্ক আছে। প্রায়ই আমাকে তালাক দিতে চায়। এনিয়ে অনেকবার ঝগড়া হয়েছে। আমাকে মারপিটও করেছে। বৃহস্পতিবার মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার পর অনেকবার মোবাইলে মেয়েকে ফেরত চাইলেও দেননি। তার স্বামীই তাদের একমাত্র সন্তানকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেন সেবা। ঘটনার প্রকৃতি এমন নয়। তবে নিষ্ঠুরতার মাত্রা তীব্রই। মাদারীপুরের কালকিনিতে নবম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। অভিযুক্ত খুনিকে অবশ্য জনগণের সহায়তায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু অমানবিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। আসলে এইসব অমানবিকতার কি কোনো ব্যাখ্যা আছে। নিজ কন্যার হাতে পুলিশ দম্পতির হত্যাকাণ্ড হতচকিত করে দিয়েছিল বাংলাদেশের সমাজকে। উচ্চারিত হয়েছিল নানা ধরনের সতর্ক বাণী। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। একের পর এক ঘটেই চলছে এমন ঘটনা। মায়ের হাতে খুন হচ্ছেন সন্তান। সন্তানের হাতে মা। নিষ্পাপ শিশুর ক্ষতবিক্ষত দেহ যেন মানবিকতারই মৃত্যু ঘোষণা করছে। মানুষ যেন আজ পশুরও অদম।
শিশু সন্তানকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যার চেষ্টা
স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে জানান, রাজশাহীতে সাত বছরের একমাত্র শিশু সন্তানকে কুপিয়ে হত্যার পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন পাষণ্ড মা। ঘটনাটি ঘটেছে গত শনিবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে নগরীর নতুন বুধপাড়া এলাকায়। পরে ঘরের দরজা ভেঙ্গে নিহত শিশু শাহরিয়ার আলম কাব্যর লাশ এবং আহত মা তসলিমা খাতুনকে (৩৫) উদ্ধার করা হয়। এদিকে গতকাল দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিহত শিশুর লাশের ময়নাতদন্ত শেষে দাদির বাড়ি হাদিরমোড় এলাকায় নেয়া হলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। ঈদের ছুটিতে এই বাড়িটিতে ছুটে এসেছিল কাব্য। বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিল। অথচ বাড়ি থেকে যাওয়ার পরদিন বাড়ির আঙিনায় যে কাব্যের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে হবে তা কেউ ভাবেনি। নিহত কাব্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণির ছাত্র ছিল। পিতা রফিকুল ইসলাম নগরীর মেহেরচণ্ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং এলাকার মোড়ে ওষুধের দোকান রয়েছে।
কাব্যর ফুফু নুরনাহার লাভলি ও পিংকি মানবজমিনকে জানান, তার মেজ ভাই রফিকুল ইসলাম বড় ভাইয়ের মতো একজন পিতার মতো সবাইকে আগলে রেখেছিলেন। এই বাড়িতেই তারা থাকতেন। কিন্তু ভাবী (কাব্যর মা) মানিয়ে নিতে না পারায় চার বছর আগে তারা আলাদাভাবে নতুন বুধপাড়া এলাকায় ওঠেন। কাব্য এবার ঈদে বাড়িতে এসেছিল, সবাইকে মাতিয়ে রাখে। ক’দিন থাকার পর গত শনিবার দুপুরে ভাই (কাব্যর পিতা) এসে তাকে নিয়ে যায়। পরে রাতে কাব্যর মৃত্যুর কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। এমন ফুটফুটে ছেলেকে কেউ কীভাবে হত্যা করতে পারে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সূত্র মতে, শনিবার রাত ১০টার দিকে নতুন বুধপাড়া এলাকার স্কুলশিক্ষক রফিকুল ইসলামের স্ত্রী তসলিমা বেগম ঘরের দরজা বন্ধ করে একমাত্র শিশু সন্তান শাহরিয়ার আলম কাব্যকে খুন করেন। এরপর তিনি নিজেও অস্ত্রের কোপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। এ সময় চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনে প্রতিবেশীরা রফিকুল ইসলামকে ফোনে জানান। খবর পেয়ে তিনি দোকান থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে দেখেন ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকানো। তিনি তার স্ত্রী এবং সন্তানকে ডাকাডাকি করতে থাকেন। একপর্যায়ে রফিকুল ইসলাম এলাকাবাসীর সহায়তায় ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে দেখেন ঘরের এক কোনায় ছেলের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। আর তার পাশেই আহত অবস্থায় পড়ে আছে মা তসলিমা। পরে মতিহার থানা পুলিশ এসে কাব্যর লাশ উদ্ধার করে। আর অজ্ঞান অবস্থায় আটক করে তসলিমা বেগমকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি চাপাতিও উদ্ধার করা হয়।
কাব্যর স্বজনদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তসলিমা বেগম মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। আর এজন্য তার সন্তানকে হত্যা করতে পারেন। তবে স্থানীয়রা দাবি করছেন, তসলিমা বেগম মানসিক ভারসাম্যহীন  কেউ বুঝতে পারেনি। কারো সঙ্গে মিশতেন না। তবে তসলিমা ও রফিকুল ইসলামের মধ্যে দাম্পত্য কলহ ছিল। বিবাহ-বিচ্ছেদেরও কথা চলছিল শুনেছেন। এর জের ধরেই তসলিমা তার সন্তানকে হত্যা করতে পারেন বলে তাদের ধারণা।
লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক এনামুল হক জানান, ধারালো অস্ত্রের চারটি কোপে কাব্যর মৃত্যু হয়েছে। আঘাতগুলো সবই মাথার ওপরের অংশে। এই আঘাতের ফলে মাথা থেকে কিছু মগজও বের হয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে লাশের দেহে অন্য কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।
তিনি আরো বলেন, আঘাতের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডটি পূর্ব পরিকল্পিত। হঠাৎ রাগের বশে সংঘটিত হওয়া খুন নয়।
মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ন কবির মানবজমিনকে জানান, ছেলেকে হত্যার পরেই মা আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। তার শরীরেও জখমের চিহ্ন রয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, সে আত্মহত্যা চেষ্টা চালিয়েছে। এ ছাড়া তসলিমা কিছুটা মানসিক ভাবসাম্যহীন ছিলেন বলেও পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছে।
ওসি জানান, তসলিমাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসাধীন। ঘটনাস্থল থেকে একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
রংপুরে শিশুর লাশ উদ্ধার, বাবার বিরুদ্ধে মামলা
স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে জানান, রংপুরে ২ বছর বয়সী শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল তাজহাট এলাকা থেকে এ লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। নিহত শিশুটির নাম আলিফা বেগম। সে দর্শনা মানদাই এলাকার দুদু মিয়ার মেয়ে। এ ব্যাপারে মেয়ে হত্যার অভিযোগে বাবার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। রংপুর কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম জানান, রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের তাজহাট ভিআইপি কোল্ড স্টোরেজের পাশে একটি কলা ক্ষেতে এক শিশুর লাশ পড়ে আছে এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশ সেখানে যায়। এরপর লাশটি উদ্ধার করে মর্গে প্রেরণ করে। প্রাথমিকভাবে হত্যার কারণ জানা যায়নি। ওসি আরো বলেন, এ ঘটনায় শিশুটির নানি আফরোজা বেগম বাদী হয়ে রংপুর কোতোয়ালি থানার নিহত শিশুর বাবা দুদুসহ সাতজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার পর থেকে দুদুসহ অন্যান্য আসামিরা আত্মগোপন করেছেন। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান চলছে বলে পুলিশ জানায়। কী কারণে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *