থেমে থেমে পথচলা

Slider জাতীয় সারাদেশ

31117_f2

 

ঢাকা; ভোগান্তি মাথায় নিয়েই ছুটছেন ঘরমুখো মানুষ। বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেককে ছাদে এমনকি ট্রাকে চড়েও ফিরছেন আপন ঠিকানায়। গতকাল মহাসড়কগুলোতে ছিল অতিরিক্ত যানজট। এছাড়া অধিকাংশ বাস সময়মতো টার্মিানলে না পৌঁছায় যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছেড়ে যাওয়া দু’টি ট্রেন শিডিউলে কিছুটা বিলম্ব হলেও বাকি ট্রেন প্রায় সময়মতো ছেড়েছে। এদিকে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে মানুষ রাজধানী ছাড়ার কারণে ফাঁকা হয়ে আসছে চিরাচেনা শহর ঢাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মানুষের যাত্রা পুরোপুরি স্বস্তিদায়ক করতে পারব এমন আশ্বাস দিচ্ছি না। তবে যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। এদিকে গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালে অগ্রিম টিকিট কিনেও বাসের জন্য দীর্ঘ সময় বসে ছিলেন যাত্রীরা। সমস্যা হতে পারে এই বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্দিষ্ট সময়ের আগে টার্মিনালে যান তারা। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে তারা বাসের দেখা পান। যানজট থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে বাস পৌঁছাতে পারেনি এমন দাবি ছিল বাস কর্মচারীদের। রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে দীর্ঘ অপেক্ষার অভিযোগ করেন অগ্রিম টিকিট কেনা  যাত্রীরা। যাত্রী জসিম উদ্দিন বলেন, পরিবহনের লোকজন বলছে যানজটের কারণে গাড়ি দেরিতে ঢাকায় পৌঁছছে। টিকিট কাউন্টার মাস্টার বলেন, মহাসড়কে যানজট লেগে আছে। এ ছাড়া ফেরি পারাপারে সময় নষ্ট হচ্ছে। গরু বোঝাই ট্রাক ও রাস্তার পাশে পশুরহাটের কারণে সমস্যা হচ্ছে। দূরপাল্লার যাত্রীরা অভিযোগ করেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বেশি ভোগান্তি হচ্ছে। সকালে গাবতলী টার্মিনালে বাস ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও অনেকে দেখা পাননি কাঙিক্ষত গাড়ির। কখন আসবে ঈদের অগ্রিম টিকিটের সেই গাড়ি- তাও বলতে পারছিলেন না কাউন্টারের লোকজন। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার কথাই বারবার বলেছেন তারা। এদিকে অনেক যাত্রী ভাড়া বেশি রাখার অভিযোগ করেছেন। তাও অস্বীকার করেছেন কাউন্টারের লোকজন। সকালে গাবতলী টার্মিনালে উত্তরবঙ্গগামী বাস কাউন্টারগুলোর সামনে যাত্রীদের ব্যাপক ভিড় ছিল।  যাদের অনেকে ভোর থেকে অপেক্ষায় ছিলেন বাসের। এক যাত্রী বলেন, আমার গাড়ি ছিল সাড়ে ৭টায়; সাড়ে ৯টার সময়ও বাস আসে নাই। কেয়া পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার মফিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই এই সমস্যা হচ্ছে। মূল কারণ হচ্ছে পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি চলছে না ঠিকমত। তাই খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরার বাসগুলো সব এলেঙ্গা দিয়ে ঢুকছে। এ কারণ এলেঙ্গা থেকেই জ্যাম শুরু হয়েছে।
রেল ও লঞ্চ ঘাটে অভিন্ন চিত্র: এদিকে সকাল থেকেই আস্তে আস্তে সদরঘাটে যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। পরিবার-পরিজন নিয়ে লঞ্চযাত্রীরা আগেভাগেই ঘাটে পৌঁছান। কাঙিক্ষত লঞ্চের অপেক্ষায় ছিলেন হাজার হাজার মানুষ। ভোলাগামী যাত্রী বিল্লাহ বলেন, ঈদের সময় বাড়ি যেতে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তারপরেও বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদে বাড়ি থাকলে আনন্দের কমতি থাকে না। ঘাটে কোন লঞ্চ না পেয়ে যাত্রীরা পন্টুন থেকে নৌকাযোগে নদীর মাঝখানে নোঙর করে রাখা লঞ্চে উঠেন। পন্টুনে আসার আগেই নদীর মাঝখানেই লঞ্চগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ওদিকে কমলাপুর স্টেশনে রাজশাহীগামী দু’টি ট্রেন রাজশাহী এক্সপ্রেস ও সিল্ক সিটি সময়মতো না ছাড়ায় যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে দেখা যায়। গতকাল  সকালে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রাজশাহীগামী ধূমকেতু, খুলনাগামী সুন্দরবন এবং চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলাসহ অন্যান্য ট্রেন প্রায় ঠিক সময়েই ছেড়ে যায়। এসব ট্রেনে ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদেও চড়েছেন অনেকে। কমলাপুর রেলস্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী জানান, এবার ট্রেনে কোনো শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে না। মোটামুটি সব ট্রেনই যথাসময়ে কমলাপুর থেকে ছাড়ছে।
মন্ত্রী যা বললেন- শুক্রবার সকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সারাব এলাকায় একটি পাতালপথ (আন্ডারপাস) উদ্বোধনের সময় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে সব রকমের চেষ্টা চলছে। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালের সামনে কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কে ওই পাতালপথের উদ্বোধন করা হয়। মন্ত্রী বলেন, যানজট নিরসনে পুলিশের সঙ্গে স্কাউট, কমিউনিটি পুলিশ কাজ করছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলার অভাবকে ‘বড় সমস্যা’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, কেউ ধৈর্য ধরতে চান না।  অনেকে উল্টো পথে গাড়ি চালান। এসব কারণে মহাসড়কে যানজট আরও বেড়ে যায়। পুলিশকে বলা হয়েছে, উল্টো পথে যারাই যাবেন, তিনি মন্ত্রী হন আর ভিআইপি হন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। ঈদুল আজহার সময়টা নানা কারণে চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এ সময় সড়কের পাশে কোরবানির পশুর হাট বসে। মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন পশুবাহী ট্রাক চলে। এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এসব বিষয় দেখার জন্য জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ মদনপুর-ভুলতা-দেবগ্রাম (এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক) ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়েছে শত শত যানবাহন। ভোগান্তির শিকার হয়েছেন যাত্রীসাধারণ ও মালবাহী যানবাহনের চালকরা। গতকাল সকাল থেকে বিকাল অবধি উপজেলার এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের কাঞ্চন সেতুর উভয় দিকে ৪ কিলোমিটার এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের গোলাকান্দাইল গোলচত্বরের চতুর্দিকে ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ যানজটের সৃষ্টি হয়। কাঞ্চন টোলপ্লাজায় টোল আদায়ে বিলম্ব ও কাঞ্চন সেতুর উভয়পাশের রাস্তায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় যানবাহন ধীর গতিতে চলার দরুন। আর ভুলতা ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের জন্য, গরুর হাট ও ফুটপাথ দখলকে যানজটের জন্য দায়ী করছেন যাত্রী ও চালকেরা।
পরিবহন চালক ও যাত্রীরা জানান, উপজেলার ভুলতা হয়ে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের ৩২টি রুটে যানবাহন চলাচল করে এ সড়কে। ঈদকে ঘিরে স্থানে স্থানে মালবাহী গাড়ি, বিশেষ করে গরু ভর্তি ট্রাক আটক করে পুলিশ চাঁদা আদায় করে। কাঞ্চন ব্রিজের টোলপ্লাজায় টোল আদায়ে বিলম্ব করা, ব্রিজের উভয়পাশে রাস্তা খানাখন্দ থাকায় যানবাহনের গতি কমে যায়। ফলে যানজট এখন নিত্যদিনের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে ভুলতা ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের পূর্বে বিকল্প রাস্তা নির্মাণ না করেই ফ্লাইওভারের কাজ করায় ভুলতা, গোলাকান্দাইল এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। এছাড়াও সড়কের উপর রয়েছে কাঁচাবাজার, বিভিন্ন যানবাহনের একাধিক অবৈধ স্ট্যান্ড। ফলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা এলাকাতেও যানজট এখন নিত্যদিনের। ঈদকে সামনে রেখে ভুলতা এলাকায় যানজট আরো বেড়েছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এ সড়কে চলাচলরত দূরপাল্লা ঈদগামী যাত্রীসাধারণ।
গরু বহনকারী চাঁদপুরগামী ট্রাক চালক ওমর আলী জানান, পুলিশের যন্ত্রণায় গাড়ি চালানো দুষ্কর। শুধু শুধু গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার ১/২শ’ টাকা দিলে সব ঠিক।
রংপুরগামী মালবাহী কার্গো চালক আলেপ হোসেন জানান, চট্টগ্রাম থেকে মাল লোড করে রংপুরের উদ্দেশ্যে মঙ্গলবার ভোরে রওনা দেই। রূপগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় যানজটে আটকা পড়ে ৩ ঘণ্টা পর মুক্তি পাই। ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মাহবুব হোসেন বলেন, যানবাহনের বাড়তি চাপের কারণে এবং রাস্তা খারাপ বলে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা নিরলস পরিশ্রম করছি। তাড়াতাড়ি যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করছি।
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, ঈদের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দীর্ঘ হচ্ছে ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানবাহনের সারি। গতকাল ভোর থেকে ৭৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। গোড়াই থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম পাড় সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড়া পর্যন্ত তীব্র যানজট হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে সড়কের নাটিয়াপাড়ায় আনারসবাহী একটি ট্রাকের সঙ্গে অপর বাসের সংঘর্ষ, কালিয়াকৈরে দুই বাসের সংঘর্ষ, কোরবানির পশুবাহী ট্রাকসহ অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে এ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর ভোর ৬টায় ঢাকাগামী একটি বাস বিকল হওয়ায় যানজট আরো দীর্ঘ হয়। যানবাহনের চাপ কমাতে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজার সবক’টি লেন খুলে দেয়া হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন থেমে থাকায় চরম বিপাকে রয়েছে ঘরমুখো যাত্রীরা।
এ বিষয়ে এলেঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভোর রাতে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর বাস বিকল, নাটিয়াপাড়ায় আনারসবাহী ট্রাক ও বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকল ট্রাকটি সরাতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লেগেছিলো। এর জন্য কিছুটা যানজট হয়েছে। তবে যানজট নিরসনে পুলিশ নিরলসসভাবে কাজ  করছে।
এ বিষয়ে কথা হয় গোড়াই হাইওয়ে থানার সাব ইন্স্পেক্টর আরিফুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার বিকালে কালিয়াকৈরে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জন মারা গেছেন। এতে যানজট সৃষ্টি হয়। রাতে আরেকটি দুর্ঘটনার পর থেকে পুনরায় যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে পশুবাহী ট্রাকের জন্য মহাসড়কে ধীর গতিতে চলছে যানবাহন।
যানজটের কারণ: উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার গাজীপুরের চন্দ্রা। ঢাকার সাভার ও গাজীপুর থেকে উত্তরবঙ্গগামী একটি প্রবেশদ্বার এবং উত্তরবঙ্গ থেকে একই প্রবেশ মুখে রয়েছে চন্দ্রার গোলচত্বর। অতিরিক্ত গাড়ির চাপ সৃষ্টি হলে গোলচত্বরের তিনমুখী গাড়ির মুখোমুখি অবস্থানে এক অর্থে হয়ে পড়ে তা অকার্যকর। সৃষ্টি হয় যানজটের। যা অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বেশ কয়েক কিলোমিটার জুড়ে। মহাসড়কের যানজটের আরেকটি অন্যতম কারণ কালিয়াকৈর অংশের চাপা রেল ওভার সেতু। কোনো কারণে এই রেল ওভার সেতুর উপর কোনো গাড়ি দুর্ঘটনা ও যান্ত্রিক ক্রটির কারণে বিকল হয়ে গেলে চাপা সেতু হওয়ায় দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। যার ফলে সেতু দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে সেতুর দু’পাশে লম্বা যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও অসংখ্য ফিটনেস বিহীন গাড়ি চলাচল করে সড়কটিতে। যার ফলে মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিনই একাধিক গাড়ি বিকল হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় যানজটের। এছাড়াও অনুমোদনহীন ও ধীর গতির যানবাহন চলাচল করায় যানজটের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটে অসংখ্য ট্রেন চলাচল করে। প্রত্যেকটি ট্রেনের জন্যই  ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের মির্জাপুরের রেলক্রসিং ব্যবহার করা হয়। গড়ে প্রতিটি ট্রেনের জন্য প্রায় দশ থেকে পনের মিনিট বন্ধ রাখতে হয় যান চলাচল। যার ফলে দেখা দেয় যানজট। এদিকে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে মহাসড়কে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চলাচল করছে ট্রাক। উত্তরবঙ্গ থেকে ছেড়ে আসা এই ট্রাকগুলি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়ায় অতিরিক্ত গাড়ির চাপের কারণে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
সড়কটিতে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে ও যানবাহন বিকল হচ্ছে। চাপা সড়কের কারণে দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা চালাতে পারে না উদ্ধারকারী দল। সেই সঙ্গে উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য নেই পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতি। যার ফলে অল্প সময়ের সড়কের দু’পাশে যানবাহন আটকা পড়ে সৃষ্টি হয় যানজটের।
শ্রীপুর (গাজীপুর) থেকে সংবাদদাতা জানান, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলোতে যাত্রীরা মই বেয়ে ট্রেনের ছাদে চড়ছেন। গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনগুলোর গতকালের চিত্রটা অনেকটা এরকমই ছিল। ঈদে বিশেষ করে জামালপুর, নেত্রকোনা, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ট্রেন যাত্রীদের অনেকেই ভিড় ঠেলে ট্রেনের ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। বাড়ি ফিরতে হবে বলে কথা। অনেকে ট্রেনের ভেতরে ঢুকতে না পেরে মই বেয়ে ট্রেনের ছাদে চড়ছেন সপরিবারে। এজন্য আলাদা টাকাও গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। সরেজমিন গাজীপুরের শ্রীপুর, রাজেন্দ্রপুর, কাওরাইদ রেলস্টেশন এলাকা ঘুরে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বিভিন্ন ট্রেনে মই বেয়ে যাত্রীদের ট্রেনের ছাদে উঠার এরকম চিত্র দেখা গেছে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর এসিআই ফরমুলেশন কারখানার শ্রমিক এমারত জানান, ট্রেনের ভেতরে ঢুকতে পারিনি। মইওয়ালাকে ৪০ টাকা দিয়ে মহুয়া এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাদে উঠেছি।  বাড়িতে তো যেতে হবে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের যাত্রী আবুল হোসেন। তিনি রাজেন্দ্রপুরের ডার্ড কম্পোজিট কারখানার শ্রমিক। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ট্রেনের এ ফটক ও ফটক এভাবে কয়েকটি ফটক ঘুরে ট্রেনের ভেতরে ঢুকতে পারেননি। অবশেষে মই বেয়ে ট্রেনের শেষের বগির ছাদে উঠেছেন। ছাদে উঠে হেসেই মইওয়ালাকে বললেন এই নাও তোমার ৫০ টাকা। এবার গফরগাঁও গিয়ে নামতে পারলেই বাঁচি।
রাজেন্দ্রপুর বাজারের চা বিস্কুট বিক্রেতা মনির হোসেন বলেন, প্রতি ঈদে অন্যদের সঙ্গে তিনিও মই দিয়ে যাত্রীদের ট্রেনে চড়তে সহায়তা করেন। ট্রেনে উঠে যে যাত্রী খুশি হয়ে যা দেন তাতেই সন্তুষ্ট। শ্রীপুর রেল স্টেশনে মই দিয়ে সহায়তা করা সেলিম বলেন, ঈদে সরকারি ছুটি ঘোষণা হলেই বিভিন্ন ট্রেনের সময় মতো মই নিয়ে স্টেশনে চলে আসি। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলোতে যাত্রীদের ভিড় থাকায় অনভ্যস্ত লোকদের ছাদে চড়াতে সাহায্য করি। কেউ ১০ টাকা, কেউ আবার ২০ টাকাও দেয়, দাবি করি না। রেলওয়ের লোকজন দেখলে তাড়া করে। যাত্রী বেশি থাকলে দেখার সুযোগ নেই, তাড়াও করবে কি?
নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের যাত্রী তমিজ উদ্দিন বলেন, পরিবারের লোকদের নিয়ে গাড়ির ভেতরে উঠতে পারলাম না, ছাদেও উঠতে পারলাম না, মই দিয়ে উঠারও সিরিয়াল পেলাম না।
গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে নেত্রকোনার বিরিশিরি যাবেন কামাল হোসেন। তিনি শ্রীপুরের হেমস ফ্যাশন লিমিটেডের শ্রমিক। সকাল ৭টার দিকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে শ্রীপুর রেল স্টেশনে এসেছেন বলাকা এক্সপ্রেসে যাত্রা করতে, টিকিট করেছেন যথারীতি। তিনি বলেন, ট্রেনের ভেতরে পা ফেলার জায়গা নেই। বাড়ি যেতেই হবে। তাই মই দিয়ে স্ত্রী সন্তানসহ ট্রেনের ছাদে উঠেছি।
শ্রীপুর রেল স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার আবদুল মোতালেব বলেন, ট্রেনের ছাদে উঠা ঝুঁকিপূর্ণ। ঈদ মৌসুমে যাত্রীদের নিষেধ করেও পারি না। স্থানীয় দিনমজুর শ্রেণির লোকজন এ মৌসুমে ট্রেন এলেই মই নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখলে তাড়া করি। তারপরও সুযোগ বুঝে ট্রেনের ছাদে মই লাগিয়ে দেয়।
স্টাফ রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ থেকে জানান, বিপর্যস্ত পাটুরিয়া ফেরিঘাট। এই ঘাটে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার যাত্রী ভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে। ৫-৬ ঘণ্টার নয় কম পক্ষে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার ওপরে পড়ে রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। নজিরবিহীন এই জনদুর্ভোগের কবলে পড়ে কাঁদছেন অনেকেই। কখন প্রিয়জনদের কাছে ফিরবে এটা যাত্রীদের কাছে অনিশ্চিত  হয়ে পড়েছে। যাত্রীরা এ জন্য ঘাট কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন।
গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পাটুরিয়া ঘাটে অবস্থান করে দেখা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের ঈদে ঘরমুখো হাজার হাজার মানুষের কষ্টের দৃশ্য। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শতশত যাত্রীবাহী বাস পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় আটকে থাকলেও ১০-১২ ঘণ্টায়ও পার হতে পারছে না। খাবার, টয়লেটসহ নানা কষ্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের ভেতর সময় কাটাচ্ছেন নারী যাত্রীরা। কোলের শিশুগুলো চিৎকার করে কাঁদছে এবং অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বয়স্ক মানুষগুলো। এমন করুণ দৃশ্য দেখার কেউ নেই।
যাত্রীদের অভিযোগ, এবার ঈদে ঘাট ব্যবস্থাপনা একেবারেই নাজুক হওয়ায় সর্বকালের সব চেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের মানুষগুলোর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি অপেক্ষায় থেকে যাত্রীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। যানবাহনগুলো ঘাট থেকে এতোই পেছনে যার ফলে শিশু বাচ্চাসহ সব বয়সের হাজার হাজার মানুষ দিনভর মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে পাটুরিয়া ঘাটে পৌঁছাচ্ছেন।
বিকাল ৫টার দিকে পাটুরিয়া ঘাটের চিত্র ছিল আরো ভয়াবহ। ঘাট ছাড়িয়ে যানবাহনের লাইন ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার অতিক্রম করে। পাটুরিয়া-ঢাকা সড়কে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা না থাকায় রোডের ওপর দুই-তিন সারি করে যানবাহনগুলো এলোমেলো রাখার কারণে ভয়াবহ যানজটে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। যানবাহনগুলো আগে ও  পেছনে কোনো দিকেই যেতে পারছে না। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায়।
খুলনার যাত্রী মাহমুদুল হাসান জানান, সকাল সাড়ে ১০টায় তার গাড়িটি ঘাট থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে থেমে রয়েছে। বিকাল ৫টা পর্যন্ত সেখানেই অপেক্ষা করছেন ফেরি পারাপারের অপেক্ষায়। তিনি বলেন, প্রতিনিয়তই এই পথ ধরে যাতায়াত করি। কিন্তু এই বারের মতো জীবনে কোনো দিন ফেরি পারাপারের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। অথচ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নদীর ওপর একটি ব্রিজ হলে এমন দুর্ভোগে কারো পড়তে হতো না।
যশোরের যাত্রী মজনু মিয়া ৩ বছরের পুত্র, ৬ বছরের কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে হানিফ পরিবহনে উঠেছিলেন। ঘাটে যানজট থাকায় ৪ কিলোমিটার দূরে নেমে পায়ে হেঁটে যান পাটুরিয়া ঘাটে সেখান থেকে লঞ্চে উঠে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে লোকাল বাসে যাবেন বলে জানান। শুধু আক্ষেপ করে বলেন, আমরা দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের মানুষগুলো দুর্ভাগা। দেখার কেউ নেই।
ফরিদপুরের যাত্রী ইয়াসমি বেগম বলেন, কোলে ৫ মাসের শিশু বাচ্চা। বাসে ৬-৭ ঘণ্টা বসে আছি। বাচ্চাটি চিৎকার করে কাঁদছে। কান্না থামাতেই পারছি না। বলেন, আল্লাহ আমাদের রক্ষা করো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্নি আক্তার জানান, আরো ৩ ঘণ্টা আগেই খুলনা চলে যেতাম ঘাটে যদি যানজট না থাকতো। বাবা-মা ও ভাইয়া টেনশনে রয়েছে কখন বাড়ি ফিরবো। কিছুক্ষণ পরপর তারা ফোন দিচ্ছে। কখন ফিরবো জানি না। ঈদে ঘরমুখো এ রকম হাজার হাজার যাত্রী পাটুরিয়া ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় থেকে নাভিশ্বাস হয়ে উঠছেন।
এদিকে সকাল ১০টার দিকে পাটুরিয়া তিন নম্বর ঘাটে বেধে যায় বাসযাত্রী ও ভিআইপি যানবাহনের যাত্রী এবং চালকদের মধ্যে উত্তেজনা। এ সময় অনেকে লাঠি নিয়ে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসের চালকদের ওপর চড়াও হয়। বাস যাত্রীদের অভিযোগ ঘাট কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে কালো বাজারে টিকিট দিচ্ছে ভিআইপি বাসগুলোকে। পরে পুলিশ র‌্যাব ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে  দৌলতদিয়া প্রান্তে ৪টি ঘাটের মধ্যে বৃহস্পতিবার  রাতে ২টি ফেরি ঘাট কোনো রকমে মেরামত করা হলেও সে ঘাটগুলোতে স্রোতের কারণে ফেরি ভিড়তে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি দুপুরের দিকে ৩ নম্বর ঘাটটি ভেঙ্গে যায়। মেরামত করা ঘাটগুলো দিয়ে সীমিত আকারে ফেরি চলছে। ফলে পাটুরিয়া ঘাটে যাত্রী দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করছে। দৌলতদিয়া ঘাটেও পশুবাহী ট্রাকসহ যাত্রীবাহী হাজারো বাস ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানাযায়।
বিআইডাব্লিউটিসির আরিচার অঞ্চলের ডিজিএম শেখ মো. নাসিম জানান, দৌলতদিয়া প্রান্তে ঘাট সমস্যার কারণে এবার ঈদে যাত্রীদের ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সেখানে চারটি ঘাটের মধ্যে দুই ঘাট পুরোপুরি সচল থাকলে বাকি দুটি ঘাট আংশিক সচল থাকায় ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *