মন্ত্রিত্ব বহালের সুযোগ আছে কি?

Slider টপ নিউজ

30364_b6

 

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানে শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে আদালত অবমাননার সাজার রায়ে আপিল বিভাগ অভিমত দিয়েছেন। আমাদের সংবিধানের ১৪৮ (১) মোতাবেক শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করবেন। আর ১৪৮ (৩) মোতাবেক কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথ গ্রহণ আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর কার্যভার গ্রহণ করেছে বলে গণ্য হবে বলে নির্দেশনা দিয়েছে। সুতরাং যে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথ নিতে হয়েছে সেই শপথ ভঙ্গের কারণে শপথের অবসান হয়েছে। আর শপথ অবসানের কারণে তার কার্যভারও অপসারিত হয়েছে। আদালতের রায় ঘোষণার পর পর দুই মন্ত্রীর শপথের অবসান হয়েছে।
শপথের অবসান হওয়ার পর মন্ত্রী পদে বহাল থেকে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করা, মন্ত্রণালয়ের ফাইলে স্বাক্ষর করা, পতাকাবাহী গাড়ি ব্যবহার করা, এমনকি মন্ত্রিপরিষদ সভায় উপস্থিত হওয়া হবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক। অতএব এখন সরকারের দায়িত্ব আদালতের রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রীদ্বয়ের শূন্য পদের প্রজ্ঞাপন জারি করার লক্ষ্যে দ্রুত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানীকে আদালত অবমাননার দায়ে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট ৩০ সেকেন্ড সাজা দিয়েছিলেন। এই সাজার ফলে আদালত থেকে বের হয়ে গিলানী পদত্যাগ করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশে গত ২৭শে মার্চ আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে দুই মন্ত্রীকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
ঙধঃযং ড়ভ ঙভভরপব এর বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের অনেক দেশেই প্রায় একই রকম আইন-বিধান বা রীতি অনুসরণ করা হয়। যারা শপথ গ্রহণকারী তারা যদি শপথ ভঙ্গ করেন তাহলে দুই ধরনের সাজা প্রদান করা হয়। যথা ১) অপসারণ (জবসড়াধষ ড়ভ ঙভভরপব), ২) কারাগার বা জরিমানা (ঈড়হভরহসবহঃ ড়ৎ ঋরহব)। ঙধঃযং ড়ভ ঙভভরপব নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তর্নিহিত নির্দেশনাও এরকম। আমাদের মন্ত্রীদ্বয় দোষ স্বীকার করে জরিমানা দিয়েছেন এখন রাষ্ট্রের দায় হচ্ছে তাদের অপসারণ করা। রাষ্ট্রের এই দায় বহন করতে সরকার বাধ্য।
সংবিধানের শপথ ভঙ্গ করলে পরিণতি কী হবে আদালত অবমাননার অভিযোগের বিষয়ে শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সে প্রশ্ন তুলেছিলেন। শপথ ভঙ্গ যে গুরুতর আইনগত ও নৈতিক অপরাধ প্রধান বিচারপতি তাই নিশ্চিত করেছেন। আর এখন যদি সংবিধানের শপথ ভঙ্গ করার জন্য দুই মন্ত্রীকে কোনো পরিণতিই বহন করতে না হয় তাহলে শপথ গ্রহণের আবশ্যকতারই কোনো প্রয়োজন পড়বে না এবং বঙ্গভবনে আর অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শপথও নিতে হবে না। সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায় সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অকার্যকর হয়ে পড়বে।
সংবিধানের শপথের রয়েছে গভীর তাৎপর্য। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আইনবহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষতিকর পরিণতি থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার যে নৈতিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয় তাই হচ্ছে শপথ। রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে “শপথ” হচ্ছে অন্তর্নিহিত প্রেরণা। আর এই জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোয় সর্বোচ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে শপথ গ্রহণ সংবিধানের ১৪৮ (৩) এ আবশ্যক করা হয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শপথ যারা গ্রহণ করবেন তারা অবশ্যই জ্ঞান ও উচ্চতম আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। যারা পরার্থপর লোকহিতকর, স্বার্থপরতা শূন্য, ন্যায়পরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠ তারাই উচ্চ পদের দায়িত্ব শপথ নিয়ে পালন করবেন- এটাই সংবিধানের শপথের মর্মবাণী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্র হবে বিবেক-বিচার, নীতি-নৈতিকতার নৈতিক প্রতিষ্ঠান।
সংবিধান সংসদ প্রণীত সর্বোচ্চ আইন। সংসদ কর্তৃক সংবিধানের ৫ম, ৮ম, ১৩তম  সংশোধনীকে সংবিধানের এখতিয়ারবহির্ভূত ও অবৈধ বলে রায় দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। আর সর্বোচ্চ আদালতের এ রায় কার্যকর করেছে সরকার।
আর আমাদের সংবিধানে আপিল বিভাগকে ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক উপদেশমূলক এখতিয়ার দিয়েছে।
কোর্ট রায় দেয়ার পর সংবিধানের সংশোধনী যেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায় সেখানে শপথ লঙ্ঘনের মতো একটি স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ রায়ের পর মন্ত্রী পদে বহাল রাখার প্রশ্নটি শুধু সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল নয়-আদালত অবমাননারও শামিল। সরকার যদি মন্ত্রীদ্বয়কে অপসারণ না করেন তাহলে বড় ধরনের শাসনতান্ত্রিক সংকটে পড়বেন। যা শাসনতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য শুভ নয়।

শহীদুল্লাহ ফরায়জী
লেখক: গীতিকবি
ই-মেইল: [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *